এদুয়ার্দো গ্যালেয়ানোর তিনটি গদ্য, ভাষান্তর- মঞ্জুরুল ইকরাম
লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিক এদুয়ার্দো গ্যালেয়ানোকে এমন এক পুলিশ বলা যেতে যিনি ক্ষমতাশালীর কলমে লেখা ইতিহাসের চাতুর্য্যকে গ্রেফতার করেছেন। তাকে বলা যায় এমন এক মারদাঙ্গা কবি যার হাতে ছোট্ট সব গল্পে অন্ত্যজ সাধারণের বয়ানে সৃষ্টি হয়েছে অভিনব এক জুক্সটাপোজ, যাকে কবিতা বললেই বেশি মানায়। ফুটবল অন্তঃপ্রাণ এই মহান সাহিত্যিকের দিকে বিশ্বের নজর জোরেশোরে পড়ে যখন হুগো চাভেজ বলিভিয়া সফরে আসা বারাক ওবামার হাতে তুলে দেন গ্যালেয়ানোর ‘ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা’ বইটা। তবে মিররস মূলত আকারে ও প্রকারে আরো হয়তো বিশাল। প্রাগৈতিহাসিক থেকে বর্তমান মানুষের গল্প বলে গেছেন তিনি প্রতিচ্ছায়াবাদী বিবরণ থেকে হঠাৎই চাবুক মারার নির্মমতায়। দারিদ্র, ধর্ম, জাতি ও লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে অসহায় অসংখ্য মানুষের অবতার হিসেবে প্রেরিত এসব গল্প আমাদের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া নিছক সাধারণ এক দুর্ঘটনার কথাই কেবল মনে করিয়ে দেয়।
কোন দুর্ঘটনা?
যখনই নিজেদের ‘ঠিক’ ভাবা আরম্ভ করেছি।
ঠিক কী?
রুটির উপর মাখনের স্তরে রুটিকে সম্পূর্ণ ভুলে কেবল মাখনকেই বাস্তব ভাবা।
অরিজিন অফ রাইটিং
এটা সেই সময় যখন ইরাক নামটার জন্ম না হলেও সেই মাটিতে জন্ম হয়েছিল প্রথম লিখিত শব্দের।
সেই শব্দ দেখতে ছিলো পাখির পথের মতোই আলতো। এরপর ধারালো বেত দিয়ে দক্ষ কোন আদিম শিল্পী শব্দগুলো এঁকে দেয় কাদামাটির উপর।
আগুনের চরিত্র ঈশ্বর বা মানুষের অনুরূপ ; ধ্বংসকারী, রক্ষাকারী, খুনি আবার প্রাণদায়িনী। কাদামাটিকে পুড়িয়ে শক্ত ও মজবুত করলো আগুন। তখন থেকে দৃশ্যের মাঝে চলে এলো পৃথিবীতে শব্দের অস্তিত্ব। তাই ধন্যবাদ হে অগ্নি! তোমার জন্যই মাটির ঢ্যালাগুলো এখনো ঠিক সেই কথাগুলোই বলে, হাজার হাজার বছর আগেকার দুই নদীর তীরবর্তী ভুমিতে যা বলেছিলো কোন এক আধুনিক মানুষ।
কিন্তু জর্জ ডব্লিউ বুশ হয়তো ভেবেছে যে লেখালেখির জন্মটা টেক্সাসে। নয়তো এহেন অতিরিক্ত আনন্দের সাথে ইরাককে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলার জন্য যুদ্ধ কেন করবেন? হাজার হাজার লাখ লাখ সত্ত্বা যে যুদ্ধের শিকার! হতাহতের এই তালিকায় দেখবেন, সেখানে রক্তমাংসের শরীরের চেয়েও যেন বেশি কিছু! হ্যাঁ, অলক্ষ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অজস্র স্মৃতির পাহাড়।
মাটির ঢ্যালার চেহারায় বেঁচে থাকা ইতিহাস চুরি হয়ে গেছে; নয়তো ধ্বংস হয়ে গেছে বোমার আঘাতে।
সেরক্ম একটা ঢ্যালা বলেছিল,
কী দোষ ছিলো বলো? আমরা তো কেবলই ধূলিকণা
হাওয়ার মতো বয়ে যেতে মোদের কক্ষনো ছিলো না মানা…
Origin of Writing
(Eduardo Galeano, MIRRORS: Stories of almost Everyone)
অরিজিন অফ স্লেভারি
নোয়াহর নৌকা গিয়ে পৌছেছে আরারাত পর্বতের পাদদেশে। এই আনন্দে পার্টি করেন নোয়াহ, মাতাল হন।
পার্টি শেষে যখন ফিরে আসেন তার সবকিছু নাকি ঠিকঠাক ছিলো না। বাইবেলের অসংখ্য সংস্করনের মধ্যে কেবল একটায় পাওয়া যায়, নোয়াহ যখন ঘুমায়ে ছিলেন তখন তার পুত্র হ্যাম স্বীয় পিতাকে খোজা করে ফেলেন। সেই বাইবেল অনুসারেই ঈশ্বর এহেন অপকর্মের শাস্তিস্বরূপ হ্যাম, হ্যামের বাচ্চাকাচ্চা, তাদের বাচ্চাকাচ্চা, ওই বাচ্চাকাচ্চারও বাচ্চাকাচ্চা অর্থাৎ তাবৎ উত্তরসূরিদের অভিশাপ দিলেন যে এরা শ’য়ে শ’য়ে বছর ধরেই মানুষের গোলামী করে যাবে।
কিন্তু বাইবেলের অনেক অনেক সংস্করনের কোনটাতেই ছিলো না যে হ্যামের চামড়া কালো। উপরে যে বিশেষ বাইবেলের কথা বললাম সেটা রচনার সময়ে আফ্রিকা ক্রীতদাস বিক্রি শুরু করে নাই, হ্যামের চামড়াও কালো হয় নাই। তারও অনেক পরে, একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে যখন আরবরা মরুভূমির দক্ষিণ অংশে দাস বেচাবিক্রি শুরু করে, হ্যামের চামড়ার রং তখনো ঠিকই ছিলো। তবে ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দীতে গিয়ে দাস কেনাবেচা ইউরোপের সবচে বড় ব্যবসায় পরিণত হতে হতে পাল্টে গেলো একটা ধারনা। হ্যামের গায়ের চামড়া হয়ে গেলো কুচকুচে কালো।
দাস কেনাবেচা এইভাবে পেয়ে গেলো এক চিরন্তন অনুমোদন আর অনন্তকাল যাবত বৈধতার সার্টিফিকেট। এইভাবে তৈরি হওয়া কারনগুলো সার্ভিস দিতে থাকলো ধর্মতন্ত্রকে, ধর্মতন্ত্র সার্ভিস দিতে থাকলো নিপীড়নকে। আর গোলামেরা যেহেতু কালো, হ্যামের তাই কালো হতেই হলো। হ্যামের বাচ্চাকাচ্চারাও সে হিসেবে জন্মগতভাবেই গোলাম ও কালো। কারণ এই ধর্মতন্ত্রের খপ্পরে পরে যাওয়া ঈশ্বরের কখনোই ভুল করার সুযোগ থাকে না।
বিশ্রি কোঁকড়ানো চুল, রক্তাভ চোখ, বেশিই মোটা ঠোঁটবিশিষ্ট হ্যামের উত্তরসূরিরা অসভ্যের মতো পুরুষাঙ্গ বের করে ন্যাংটো হয়য়ে ঘুরেফিরে বেড়ায়। এদের ভাবনাচিন্তা চোরের মতো। এরা ঘেন্না করে মালিককে। কখনোই সত্যি কথা বলে না। আর যখন সবার ঘুমোবার সময়, তখনো এদের সময় কাটে বিবিধ নোংরামিতে।
দি স্টেডিয়াম
আপনি কি কখনো একদম খালি কোন স্টেডিয়ামের ভিতরে ঢুকছেন? যদি না ঢুকে থাকেন তো ঢুকেন। মাঠের ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ান আর কান পেতে শুনেন। দেখবেন, শুন্য স্টেডিয়ামের চেয়ে বেশি শুন্যতা ধারন করে না স্মৃতি হারিয়ে ফেলা কোন মানুষও। বুঝবেন, বাকশক্তিহীন একদল মানুষের চেয়েও শুন্য স্টেডিয়ামে বাস করে অধিক মৌন মুখরতা।
ওয়েম্বলির বাতাসে এখনো প্রতিধ্বনিত হয় ১৯৬৬ সালের আনন্দ ধ্বনি, যে বছর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জেতে। কিন্তু সেই বিজয়োল্লাসের আড়ালে চাপা কোন আর্তনাদ যদি শুনেও ফেলেন তো আপনি ভুল করেন নাই। হাঙ্গেরিয়ানদের কাছে ১৯৫৩ সালে হেরে যাওয়ার দিনে কান্নার রোল উঠেছিল তো এই ওয়েম্বলিতেই।
উরুগুইয়ান ফুটবলের স্বর্ণালী দিনগুলার স্মৃতিচারণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্টেভিডিওর সেন্টানারিও স্টেডিয়াম। ১৯৫০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের পরাজয়ে শুরু হয়েছিল মারাকানার কান্না; তা হয়তো থামবেনা সামনের শতাব্দীতেও। বুয়েন্স আয়ার্সের বোমবোনেরায় ড্রামস গম্ভীর গর্জন করছে অর্ধ শতাব্দী ধরে। প্রাচীন মেক্সিকান ফুটবলের সময়কার, বিউটি থেকে ডিউটির দিকে যখন শুরু হয় নাই ফুটবলের ট্র্যাজিক যাত্রা, সেই সময়কার বাদ্য বাজনা ভেসে আসে তেমনি এ্যাজটেকা স্টেডিয়ামের খুব গভীর থেকে।
বার্সেলোনার ন্যু ক্যাম্পের প্রতিটা ইটের ভাষাও ক্যাটালান। আবার, বিলবাওয়ের সান মামেসের দর্শক সারিগুলোর মাঝখানে আটকে আছে যে অনুভুতিগুলা, বাস্ক ছাড়া অন্য কোন ভাষায় তার অনুবাদ স্রেফ অসম্ভব। গুইসেপ্পে মিয়াজ্জার ভূত গোলের পর গোল করে যাচ্ছে আর সেই নামের চিৎকারে কেঁপে উঠে মিলান। ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে জিতেছিল জার্মানী। সেই থেকে মিউনিখের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে সেই ম্যাচটাই চলছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ধরে।
সৌদী আরবের কিং ফাহাদ স্টেডিয়ামের আছে সোনা আর মার্বেল পাথরে মোড়ানো বক্স, সম্পূর্ণ কার্পেট বিছানো স্ট্যান্ড। কিন্তু তার কোন স্মৃতি নাই, নাই সেভাবে বলার মতো কিছুই।
THE STADIUM
(Eduardo Galeano, Soccer In Sun And Shadow)