কবিতা 

হাজং ভাষাগোষ্ঠীর কবি ও কবিতা

হাজং সাহিত্যের পাতায় বড় অংশ জুড়ে কবিতা দখল করে আছে। হাজং কবিরা তাদের কবিতাগুলোর মধ্যে নিজস্ব শিল্প সংস্কৃতির কথা, প্রাকৃতিক নানা বিষয়, সামাজিক অবস্থা, দেশপ্রেম, প্রণয়ের কথা, নানা উৎসবের কথাই বেশির ভাগ প্রকাশ করে থাকে। হাজং সম্প্রদায়ের তিনজন কবি ও তাদের কবিতা এবার পাঠ করা যাক।

 

হরিদাস হাজং এর কবিতা

কবি হরিদাস হাজং এর কবিতাগুলো পাঠ করলে দেখা যাবে যে, তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে কখনো বন্ধুকে তার শৈশবে ফিরিয়ে নিতে চাইছেন। আবার খুবই গর্বের সাথে হাজং হবার কথা, নিজের জাতিসত্তা হারিয়ে না ফেলার কথাও উল্লেখ করেছেন।

হুমাস

ও হুমাস মুলা
তগে নিয়ৗ কি করং?
ফুর ফুর বাতাস
চ আজি পুখি উইয়ৗ উরুং!
ও হুমাস মুলা
হুরু সুময়লৗ বলখিলা ,
বাখার মেঘনি বিজজে
পাবো কি আরো কুনুবিলা?
এগলগে স্কুলবাই যাওয়া
পতনি আম চরকে খাওয়া।
মাস্টারলা পুরা নাপা
আরো কান মুলা খাওয়া।
হারাদিন হেবাই হুবাই গুরে
সুন্দৗনি ঘরনি আহারা।
মৗয়ৗ অয় গৗল দিবারা
মনত কি আহে তুলা, উ কুথারা।
এগলগে এগরা থালিনি
ভাত খাওয়ারা।
তয় ময় মিললে
পুখি বাহা পারারা।
তগে সারে ময়
মগে সারে তয় ,
নাথাকিবৗন কুনুবুলা
কুনুদিনৗ কুনুবাই।
ও হুমাস আজি যালে কুমাই,
দুইজন দুইফেলেদে কেনেবাই?
চ আজি আবার
ফিরে যাং উ সুময়নি।
আমলা খিলালা মাত
পুখি বাহা পারা গাসনি।
চ আজি আবার
গুরে যাং জনম জাগানি।
তয় মুলা হুমাস
ময় তুলা হুমাস।
হুমাস সারে ভালা
নাপায় কাইয়ু থাকবা।
হুমাস থাকে হুমাস লগে
থাকিলেউ বিপদ হুমাসলা।

বাংলায় অনুবাদ

বন্ধু

ও বন্ধু আমার
তোকে নিয়ে কি করবো?
ফুরফুরে বাতাস
চল পাখি হয়ে উড়ি!
ও বন্ধু আমার
ছোট বেলার বল খেলা
অনেক বৃষ্টিতে ভিজে
পাবো কি আরো কোন সময়?
এক সাথে স্কুলে যাওয়া
রাস্তায় আম চুরি করে খাওয়া।
শিক্ষকের পড়া পড়তে না পাওয়া
আর কানমলা খাওয়া!
সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে
মায়ের বকা খাওয়া।
মনে কি আছে তোর, সেই কথাগুলো?
এক সাথে একই থালে ভাত খাওয়া
তুই আর আমি মিলে
পাখির বাসা পাড়ার কথা।
তোকে ছাড়া আমি
আমাকে ছাড়া তুই
থাকতাম না কোন সময়ে কোথাও।
ও বন্ধু আজকে গেলি কোথায়
দু’জন দু’দিকে কেনোইবা আমরা?
চল আজকে আবার ফিরে যাই সেই সময়ে
আমাদের খেলার মাঠ
পাখির বাসা পেড়ে ফেলা সেই গাছে।
চলো আজকে আবার
ফিরে যাই জন্মের জায়গায়।
তুই আমার বন্ধু, আমি তোর বন্ধু
বন্ধু ছাড়া কেউ থাকেনা ভালো।
বন্ধু থাকে বন্ধুর সাথে
থাকলেও বিপদ বন্ধুর।

ওমরৌ হাজং জাতি

ওমরৗ মৗন জাতি,
ওমরৗ হাজং জাতি।
আমলা আসে নিজৗলৗ ভাসা,
মননি আসে বাখার আসা।
নিজি করে নিজৗলৗ কাম,
আমাগে হুবৗই দেয় দাম।
ওমরৗ হুবৗই থাকে এগলগে,
অদি নাদারায় কুনু বিপদগে।
ওমরৗ রাও কয় হাজং কুথা দিয়ৗ,
ওমরৗ হুবাকু ভালা পাই মন দিয়ৗ ।
হুবৗই হুবালা হুমাস ওমরৗ,
নালাগে জুগরা কুনুবুলা ওমরৗ।
আসে আমলা আপনা সংস্কৃতি,
ওমরৗ হাজং জাতি।
আসে আমলা মননি জুর,
এগলগে হুবৗই থাকিবো জিবনভর।
মৗন ভালা ওমরৗ,
হাজং জাত ওমরৗ।
ওমরৗ ওগৗবো এগলগে,
ভালা রাখিবো জাতিরেগে।
ওমরৗ হাজং জাতি,
ওমরৗ হাজং জাতি।

বাংলায় অনুবাদ

আমরা হাজং জাতি

আমরা মানুষ জাতির
আমরা হাজং জাতি
আমাদের আছে নিজস্ব ভাষা,
মনেও আছে অনেক আশা।
নিজেই করি নিজের কাজ
আমাদের সবাই দেয় দাম।
আমরা সবাই থাকি একসাথে
তাই ভয় পাই না কোন বিপদকে।
আমরা কথা বলি হাজং ভাষায়
সবাই সবাইকে পছন্দ করি মন দিয়েই
সবাই সবার বন্ধু আমরা
বাঁধে না ঝগড়া কোনদিনও
আছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি
আমরা হাজং জাতি
আছে আমাদের মনে জোর
একই সাথে থাকবো জীবনভর
মানুষ ভালো আমরা
হাজং জাতি আমরা
এক সাথে যাবো এগিয়ে আমরা
ভালো রাখবো জাতিকে।
আমরা হাজং জাতি,
আমরা হাজং জাতি।

 

অপরূপা হাজং এর কবিতা-

অন্যদিকে, কবি অপরূপা হাজং এর কবিতাগুলোতে দেখা যায় যে তিনি শৈশবের দিনগুলোকেই তার কবিতায় প্রকাশ করতে পছন্দ করেন। 

আগেলা দিন ইলালা দিন

বিলা চাইয়্যা কাম কুয়া দিনদৌ শেষ
চাথালনি বুইহা চান মামা চৌয়ৌ কিচ্ছৌ হুনিবা কুথারাও যাসিগা
ঘরলা বুড়ৌ চিংড়া হাপাল তাপাল হুবৌই মিল্লে গপ কুয়া সময় আমলা নৌই
ইলা আমরা কিচ্ছৌ না হুনি, হুবৌই মিলা গপ না কয়
চোখরৌ গে থাপা থাপাকে মাথারা উফর বায় তুল্লে ইলা আমরৌ টিভি চৈয়ৌ থাকে।
মাটি নেখেন নরম মন ঘিলা আমলা ঘরলা ইট পাথর নেখেন শক্ত হইয়ৌ পাষাণ হুসে গৌ।
বেক ফুরাসে আমলা, আসে খালি কুথা ঘিলা।
তাও মিল্লে থাকং হুবৌই মিল্লে ঝিল্লে আমলা চাথাল ঘিলানি।

বাংলায় অনুবাদ

পূর্বের দিনকাল বর্তমান দিনকাল

সূর্যের দিকে তাকিয়ে কাজ করার দিনগুলো ফুরিয়ে গেছে
উঠোনে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে গল্প শোনার সময়ও চলে গেছে
ঘরের বুড়োবুড়ি, যুবক, ছোট বাচ্চারা আর কেউ একসাথে গল্প করে না
এখন আমরা কেউ গল্প শুনিনা, একে অপরের সাথে কথাও বলি না
চোখ বড়বড় করে সবাই শুধু টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে
মাটির মতো নরম মনগুলো
এখন ইট পাথরের মতো পাষাণ হয়ে গেছে
সবই ফুরিয়ে গেছে, আছে শুধু অতীত কথা
তবুও মিলেমিশে থাকি আসো আমাদের
উঠানেতে।

মেঘ দিন

হিংগুদা আহা দিন
মাটিলা আরাম কুয়া কুথা
হাপাল ঘিলালা মাটি খুইনা না খিলা।
হাল লাঙল বন্ধ রাখা গিরুস্তি ঘরলা কাম
ঘরে ঘরে খৈ ভাজা,হুবাই একলগন খাবান আম, কাহল দিয়া
পুখি ঘিলা মাথা ছিলৌকে ঘরনি আহিবৌন।
দিন্দৌ কালাকে হাজিলে বাখা দিনৌকে মেঘ আহিলে
ধানবন সামলাবা নাপালে, মেঘ থামাবাগে
দিগিপারনি মুরিচ বিয়ৌ দিবৌন
ঝাতা বারিলৌ চাইড়া কাঠি চার খাননি পুইতৌ
হুতৌ ঘিরে রৈখৌ জয় জুখা দিয়ৌ দিবৌন মুরিচ বিয়ে মেঘ থামাবৌন।
ইংকৌ থাকিবান আমলা হুতু ভুলালা মেঘ আহা দিনলৌ কুথা
ইলালা হুতু ঘিলা না দেখে এমুন দিনলৌ কাম ঘিলৌ
না জানে উরা আমলা আগেলা দিনৌলৌ নিয়ম নীতি ঘিলৌ।
ইলা খালি মুখতন হুনি ইদৌ থাকিবৈন উদৌ থাকিবৌন
আগেলা কুথা ঘিলা হুনি ইলা আমরৌ হুতু মৌন।

বাংলায় অনুবাদ

মেঘলা দিন

তাল নবমী আসার দিন
মাটির আরামে বলা কথা
বাচ্চাদের মাটি খুড়ে নে খেলা
গেরস্ত বাড়ির কাজ আর লাঙ্গল দিয়ে চাষ বন্ধ রাখা
ঘরে ঘরে ভাজতো খৈ, সবাই এক সাথে খেতো
আম, কাঁঠাল।
পাখিরাও ঘরে আসতো মাথার চুল ফেলে।
আকাশ কালো করা মেঘ জমলে
পুকুর পাড়ে দেয়া হতো মরিচ বিয়ে
ঝাটার চারটি কাঠি চারদিকে পুতে
বৃষ্টি থামানোর জন্য উলুধ্বনি দিয়ে দিতো মরি।

 

শ্রীধাম হাজং এর কবিতা-

আবার কবি শ্রীধাম হাজং এর কবিতা পাঠ করলে দেখা যায় যে উনার কবিতায় রয়েছে রোমান্টিকতার ছাপ

একদিনৗ অৗমরৗ

তুলা কপাললা রাংয়া টিপ
তুলা পিনা রাংয়া পাথিন
পরে একটিপা মুখলৗ আহি
ইংলৗ থাকিলেই হুব।
হুকনৗ গাং কুলা দিলে
একদিনৗ তয় আরো ময়
রংয়েরং বিরাব।

উত্তুর দুক্ষিনলৗ গাং
আর উলা আলামালা বাতাস
তুলা চুলৗগে হাছাওকে ছিনাব
তয় উদি চুললৗ খুপা না বানেক
তুলা কালা চুকচুকৗ চুল
আর ছিনাউ ছানাউ চুলৗ
ইদৗ হুলেও চলিব।

আমলা বিরাবুলৗ
মুলা নিব্রা হাত আর তুলা বৗত্ত হাত
আথা দক চিপাকে লাগিব।
আমলা বিরাবুলৗ
তয় যুদি কিচ্ছৗও না পায়:তুলা মুখলা আলামালা রাও
ইদৗ হুলেও চলিব।

গাং কুলালা রাংয়া আর দোলা ফুল
তয় যুবৗলা চাব
এগরা এগরাকে আন্নে দিব
তুলা হাতনি ময়
তুলা লগন ময় একদিনৗ
বাখাদুর বিরাবৗ হয়!!

বাংলায় অনুবাদ

একদিন আমরা

তোমার কপালের লাল টিপ
পড়নে তোমার লাল পাথিন
পরে একটু মুখের হাসি
এগুলো থাকলেই হবে;
শুকনো নদীর কিনারা দিয়ে
একদিন তুমি আর আমি
হাঁটবো হাসিখুশি ।

উত্তর-দক্ষণের নদী
আর তার অল্পস্বল্প হাওয়া
তোমার চুলকে এলোমেলো করবে
সেই জন্যে তুমি চুলের খোপা বাঁধিও না
তোমার নিগূঢ় কালো চুল
আর এলোমেলো চুল
এইটা হলেও চলবে।

আমাদের হাঁটার সময়
আমার বাম হা আর তোমার ডান হাত
আঠার মত লেগে থাকবে
আমাদের হাঁটার সময়
তুমি যদি গল্পও না পার; তোমার মুখের অল্প কথা
এইটা হলেও চলবে।

নদীর কিনারার লাল সাদা ফুল
তুমি যখন চাইবে
এক এক করে এনে দিব
আমি তোমার হাতে
তোমার সাথে আমি একদিন
হাঁটবো অনেক দূরে কোথাও!!

মেঘ’লা দিনৗ

মেঘ আহে টপটাপ টপটাপ
আহে হারা বিলাই,
গাঙ কুলানি গইলিংয়া পুকা
উড়ে উড়ে খিলায় ।

দাহা কুলানি পুখি-গৗলৗ
ঠাণ্ডানি চুপচাপ,
দিনলৗ রোদ আহিব কুমবৗলা
দিব উমাগে তাপ ।

গুরু-হাগল তিরিং তারাং
গরবাই যায় ফিরে,
নারীমাও সাওয়ারা হুট-হাট
গুরুলৗ লিংকুর দুরে ।

হাজং মাও দাংওর ডুবানি
আহিসে মাসলা টানে,
মাস দুরালা আসায় ইলা
জাখা খৗলৗই বানে ।

আল্লৗ মরদ হাল বুয়াই
উলা বাই-বারিনি,
মথানি উলা দাংওর জাপি
বৗচুকা আসে হাতনি ।

হারা বিলা টাংকে মেঘ
ইংকি আহে যায়,
মেঘ’লা দিনৗ মেঘ আহে
আহে পত্তে দিনৗই।

বাংলায় অনুবাদ

বৃষ্টির দিন

বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর
পড়ে সারা বেলা,
ঘাস বনে জমছে ফড়িং
করছে তারা খেলা।

পাহাড়ের পাদদেশে পাখ-পাখালি
ঠাণ্ডায় চুপচাপ,
সূর্য কখন দেখা দিবে
দিবে তাদের তাপ।

গরু ছাগল ছুটা-ছুটি
বাড়ি যায় ফিরে,
রাখাল ছেলে হুট-হাট
গরুর রশি ধরে।

হাজং মা বড় ডোবায়
আসে মাছের আশায় ,
মাছ ধরার নেশায় সে
বাঁধে জাখা খালাই (মাছ ধরার যন্ত্র বিশেষ)।

কৃষক করে হাল চাষ
তার নিজ খেতে,
মাথায় তার বৃত্ত মাথাল
লাঠি আছে হাতে।

সারা বেলা বৃষ্টি প্রচুর
এমনিই আসে যায়।
বর্ষা কালে বৃষ্টি পড়ে
পড়ে রোজ রোজ।

 

অনুবাদ: জবা রায়

Related posts