গদ্য গল্প 

শিবরাজ চৌধুরীর দুটি গল্প

কুড়ায়ে পাওয়া কিচ্ছা

লেখালেখি হইল না বইলা শেষমেশ চুড়ির ব্যবসা ধরলাম। কয়েক ডজন চুড়ি বেচা হয় প্রতিদিন, উত্সবে পার্বণে বেচি হাজার হাজার; বান্ধা খদ্দেরও আছে কয়জন। সব মিলায়ে খুব একটা খারাপ নাই আমি। বেশ্যা থাইকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা- মোটামুটি সব মহলের হাতই আমি ধরতে পারি- এরাও আমারে বিশ্বস্ত জাইনা হাত দেয়- নরম কোমল কেতাদুরস্ত হাত। এদের কারো হাত ফর্সা, কারো রোদপোড়া, কারো ঘন বাদামী। হাঁটু ভাঁজ কইরা বসে তারা, মাংসপট্টির কুকুরের মত একাগ্রতা ও সময় নিয়া চুড়ি দেখে। কাঁচের চুড়ি, কাঠের আর প্লাস্টিকের চুড়ি, এমনকি লোহার চুড়িও আমি রাখি- এদের ক্যান জানি সবকিছুই ভাল্লাগে। আমি খুব যে বুঝদার লোক এই ব্যবসায় তা না, চুড়ি আনি যা পাই যেমন। কোনদিন লাল আনি বেশী, কোনদিন হলুদ বা গোলাপি। কাঁচের চুড়ি না আইনা কাঠের চুড়ি দিয়াই সাজাইছি দোকান এমনও হইছে বহুত, তবু আমার এমন সৌভাগ্য যে সবরকম চুড়ির খদ্দেরই আমি পায়া যাই; কেমন কইরা জানি বেচা হয়া যায় সব।

সে আমার কাছে চুড়ি দেখতে আসত প্রতিদিন, কিনতনা কিছু। চুড়ি কিনবার উছিলায় সে আমারে তার হাত ধরতে দিত, আমি অবশ্য চুড়ি পরানোর উছিলায় ধরতাম। দুরকমের উছিলার মাঝে চুড়িগুলা টুং টাং বাজত। সে আনত হওয়ায় আমার দুই চোখ সমেত তার বুকের আশেপাশেও ঘুরঘুর করতাম, যেমনে পাড়ার ফার্মেসির নতুন ছেলেটা খটোমটো নামের ওষুধ খুঁজে। সে এক ছলনা ছিল; কী এক কৌশলে কেবল সমতল খুলে রাখছিল, পাহাড়ে বড় হইনাই বইলাই হয়তো এমন বঞ্চনার শিকার আমি। রুই কাতলা মৃগেল সবাই জলের কাহিনী সাঁতরায় বইলাই কি তোমার মনে হয় এদের সবার জিভে একই জল লাগে? আমি যে প্রতিদিন তার সমতল জলে সাঁতরাই, কখনো জমিদার, কখনোবা কেরানি, কখনো ভিক্ষুক হয়া স্বাদ পাই তার, কই একবারও তো একঘেয়ে লাগে না ইচ্ছাময়ীরে! তারে নিয়া এতকিছু ভাবতে ভাবতে বাকিদের কেনাদামের কমে চুড়ি বেইচা দেই, অথচ সে চুড়ি পছন্দ হয় নাই বইলা চইলা যায়, নিয়মিত। আমার কাছ থাইকা এখনো একটা চুড়িও কিনল না সে, অথচ কত টাকার লস খাইছি আমি কেবল তার লাইগা; পেট তো আর পপুলারিটি খায়া ঢেঁকুর তুলে না!

একদিন, কোন এক চানরাইতে চুড়ির দোকান বন্ধ করুম বইলা খাড়াইছি, দেখি সে আসতেছে। আর যে একজোড়া লোহার চুড়িই আছে কেবল! সে আসে আস্তে আস্তে শামুকের মতো, সে আসে উড়তে উড়তে ডাহুকের মতো, সে আসে দুলতে দুলতে মাতালের মতো। আমি হা হয়া যাই, গিলি তারে আর তার পিছে ধুঁকতে থাকা দ্বিতীয়ার চান। সে হাসে, হাঁটু মুড়াইয়া বসে, দুইরকম উছিলায় বরাবরের মতই তোমরা টুংটাং শব্দ পাও এবং সেই একজোড়া চুড়ি সে আমার হাতে পরায়ে দিলে আমি নিজেরে হাতকড়া পরা অবস্থায় খুঁইজা পাই লোহা দিয়া বানানো কোন চারকোণা ঘরে, লখিন্দরের মতন।

সিদ্ধার্থ হইলাম গো তোমার লাইগা গৃহত্যাগী বাদামের মতো; পেটে গেছি আমি কার, গৃহ গেছে সুবর্ণসাম্পানে…

 

প্রাপ্তি

আমাদের প্রাচীন আয়ুর্বেদে আমার এই বেতালা অসুখের কোন নিদান ছিল না। পুঁথিপত্র, কবিরাজ, গানরাজ এবং এলোপ্যাথ পেরিয়ে সুফি আস্তানায় ধর্ণা দেবার পর আবার আমাকে শহরের মেঘের মতন ধীরপায়ে ফিরে যেতে হয় আয়ুর্বেদের কাছে। চক্র ঘুরতে থাকে, ঘুরপাক খেতে খেতে স্বাস্থ্যহানির কারণে খেয়াল করুন, আমি ভিক্ষুক নই, চাঁদাবাজ হয়ে উঠলাম। চাঁদাবাজির তীব্রতায় আমি বিরাগভাজন হয়ে উঠলাম উচ্চ, মধ্য ও নিম্নবিত্তদের। ফাঁকতালে আমাদের দুজনার মাঝখানটুকু জুড়ে থাকা মফস্বল পালিয়ে গেল। মাঝরাতে প্রচন্ড বজ্রাঘাতে ফেটে যাওয়া তবলার ভোঁতা গোঙানির মতো আমি, আর কোন উপায় না পেয়ে ভিক্ষুক হতে চাইলাম; কিন্তু কলোনিয়াল হাওয়া একবার গায়ে লাগলে সমস্ত মাদাগাস্কার গায়ে ঘষলেও পরিষ্কার হয় না। তাই মোড়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা পিঁয়াজুর মতো গরম হাওয়া আমায় ধীরে ধীরে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আততায়ীর অন্তরের মতো ফাঁপা বানিয়ে দিল। আমাকে কেউ আর গলির ক্রিকেট খেলায় দুধভাত হিসেবেও নেয় না; এক প্রাচীন বেয়নেটে বিদ্ধ হয়ে আমি আত্মহত্যা করতে চাইলাম। অনাচার ঈশ্বর বরদাশত করেন না; তার পক্ষপাতে আমি বোধিপ্রাপ্ত হই আর নিবিড় ক্লান্তিতে আমার মাথায় কিছু আসে না বলে আমি শেষ পর্যন্ত কোন বর চাইনা।

আমার বোধিপ্রাপ্তি অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারিত হয় চারটি বেসরকারি এবং একমাত্র সরকারি চ্যানেলে, পুনঃপ্রচারিত হয় অগণিতবার; এমনকি যখন দুই বলে চার রান দরকার বাংলাদেশের, আচানক শুরু হয়ে যায় আমার বোধিপ্রাপ্তি অনুষ্ঠানের রিপিট টেলিকাস্ট। টিভি সেটের সামনে বসে কিশোর চিত্কার করে ডাকে মা-কে, মা ডাকেন বাপকে, বাপ দিগ্বিদিক আর্তচিত্কারে মহল্লার দেয়ালে দেয়ালে ফাটল তৈরী করে ফেলেন, আসে পাড়াপ্রতিবেশী, সাংবাদিক এবং পুলিশ, আসে বেহালাবাদক; এরা সকলে কোন এক বৃহত্ টিভির মাঝে ঝাঁপ দিয়ে আমাকে খুঁজে পায়। পরদিন পত্রিকার পঞ্চম পাতায় ছোট্ট একটি সাড়ে তিন ইঞ্চি পরিমাণ কলামে ‘কুখ্যাত চাঁদাবাজ নিহত’ শিরোনামে বার্তা প্রচারিত হয়।

আমি সেই শিরোনামের উপর ভোটার আইডির কর্তিত অংশ হয়ে বসে থাকি। আমার নবীন বোধি তখন গোমস্তাপাড়ার রেলিং-এ পা ঝুলিয়ে মুরব্বি কারো চোখে পড়বার ভয়ে খুব তাড়াতাড়ি করে সিগারেট শেষ করে।

জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইলঃ ০১৬৭৯৭৪৪৩১৯

Related posts