কবিতা 

মদসংখ্যা- ম্যেরী ক্রিসমাস এবং একপেগ চিয়ার্স…! ।। হেনরী স্বপন

আজকাল প্রতিবছর এমোনই হয়, আমার স্ত্রী-কন্যা যখন ক্রিসমাসের রাতে বিশেষ প্রার্থনার জন্য চার্চে চলে যায়, আমি তখন একলা ঘরে দামী কোনও ব্রান্ডের ওয়াইন খেতে খেতে ম্যোৎজার্ট আর মান্নাদে’র কণ্ঠের শ্যামা সংগীত শুনেই এই সময়টা দারুণ কাটাই। অন্তত বিগত পঁচিশ/ ত্রিশ বছরের ক্রিসমাস উদযাপনের নিয়মিত ফিরিস্তি আমার এতাটুকই। কারণ, পাদ্রীদের পরিশুদ্ধ মন্ত্রে উচ্চারিত খ্রিস্ট জন্মের মানব সৃষ্ট এই মহোৎসবে আজকাল আর চার্চের দুয়ার মরাই না কবে থেকে? সে কথা বলা খুবই মুশকিল। তবে, কৈশোরে কিংবা প্রক-যৌবনে গির্জার ঢং-ঢং শব্দে বেজেছি আনেক…! যদিও পার্থিব সেই ঝড়ো বাতাস এখন আর আমার কক্ষপথে নেই। কারণ, আধ্যাত্মিকতা এখন আমার কাছে শুধু বেঘোরের বায়ুস্রোত আর অসভ্য পুরোহিতদের ন্যংটো আস্ফালন ব্যতীত অন্য কিছু নয়।

তবে, মদ্যপানের কথা যখন উঠলই, তাতে এখন মনে পড়ছে- সুরাপানের ইতিহাসকার মার্ক ফরসাইথ তাঁর ‘আ শর্ট হিস্ট্রি অব ড্রাঙ্কেননেস’-গ্রন্থে লিখেছেন, পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চারের ক্ষেত্রেই অ্যালকোহলের একটা অনিবার্য ভূমিকা ছিল। কাজেই মানুষ জন্মের আগে থেকেই ‘মাতাল’। ইলিকবিলিক এসব বাজে কথা, আমাদের জিন মানচিত্রেই নাকি রয়ে গিয়েছে সুরাপান-প্রবণতা। আদিম মানুষ গাছ থেকে তাজা ফল পেড়ে যেমন খেয়েছে, তেমনই সেই ফল গেঁজিয়ে তা থেকে মদ বানিয়ে তাই পান করেছে। বিষয়টা নাকি এমনই ‘জলভাত’! আরও একটা কথা। মদ্যপায়ী মাত্রেই ‘মাতাল’, এমনটাও তো না। মোদ্দা কথা হচ্ছে, মদ্যপান একটা শিল্পও বটে। সে আপনার স্কচই হোক বা দেশি মদ, সেটাকে গুছিয়ে খেতেও ভালবাসেন অনেকেই।

যদিও বাঙালি জীবনে মদ বা সুরা নিয়ে বাড়াবাড়ি নতুন কিছু নয়। মদ্যপানের কথা শুনলেই একদল বাঙালি বঙ্কিম নয়ানেই তাকিয়েছে, বাঁকা মন্তব্যই করেছে আকসার। তাই, মদ্যপায়ীরা বাংলার সমাজে সমবেদনা কখনওই পায়নি। না এটা ভারতবর্ষের সেকালেও নয়, এই আমলেও তা একেবারেই সিদ্ধও নয়ই। তবুও যে কবে থেকে বাঙালি মদ্যপায়ী হতে শিখেছে, সেকেলে সনাতনী সেই ইতিহাসের জায়গাটা প্রাচীন গ্রিসের মতো স্পষ্ট নয়। প্রাচীন গ্রিক ধর্মে মদের দেবতা দিওনুসাস ছিলেন অন্যতম মান্য দেওতা। জনপ্রিয়তায় তিনি দেবরাজ জিউস বা সৌরদেব অ্যাপোলোর চাইতে কিছু কম ছিলেন না। মূলত দিওনুসাস উৎসব থেকেই জন্ম নেয় কমেডি ও ট্র্যাজেডি। কার্যত, পশ্চিমের সভ্যতা দাঁড়িয়েই রয়েছে গ্রিক দিওনুসাস (রোমান আমলে ব্যাক্কাস) ও মদের উপরে। আমাদের সংস্কৃতিতে তেমন দেবতা কই? অন্তত আমাদের চেনা-পরিচিত দেবতাদের মধ্যে কেউই মদের অধিষ্ঠাতা নন। কিন্তু তত্ত্ব-তালাশ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, বৈদিক দেবতাদের লিস্টিতে মদের দেবতা এক জন ছিলেন, তাঁর নাম ‘সোম’। হ্যাঁ, সেই বিখ্যাত ‘সোমরস’ এর নামেই তার নাম, এইটুকুই যা। তবে, বিষ্ণুপুরাণের বারুণীকে সুরার দেবতা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এহেন দেবতাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন বলেই দৈত্যরা ‘অ-সুর’। আর এঁকে গ্রহণ করেছিলেন বলেই দেবতারা ‘সুর’। আবার শ্রীকৃষ্ণের বড়ভাই বলরামের সুরাপ্রীতির কথা মহাকাব্যের কদম্ব-জাত সুরাপানের উল্লেখ সর্বজনবিদিত। সেই বর্ণনা রীতিমতো হুল্লোড়ের। বলরাম একা নন, গোপ বন্ধু ও গোপিনী বান্ধবী সহযোগে রীতিমতো জমাটি আসর। যদিও সেই পানাসক্ত বলরামের সঙ্গে মত্ত হাতির তুলনাও রয়েছে। সে দিক থেকে দেখলে বলরাম যে পান করে রীতিমতো হুল্লোরে মজে যেতেন, তা অনুমান করা দুরূহ নয়। এরপর- চর্যাপদের একাধিক গীতিতে শৌণ্ডিকালয় বা শুঁড়িখানার উল্লেখ রয়েছে বিধায়, খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মধ্যেও মদ্যপান খুব একটা গর্হিত বলে বিবেচিত হত না। আর ক্রিস্টাডেলফিয়ান গসপেলের আদিপুস্তক ৯:৩-৪ পদ, লেবীয় পুস্তক ১৭:১০ পদ) এবং লূক ২২:২০ পদ অনুসারে, যিশুখ্রিস্ট বলেছেন: “এই পানপাত্র আমার রক্তে নূতন নিয়ম, যে রক্ত তোমাদের নিমিত্ত পাতিত হয়।” ওয়াইন বা আঙ্গুরের রস খ্রিস্টের রক্তের প্রতিনিধিত্ব করে পাপের ক্ষমা ও আমাদের পবিত্রতায় মিলনের উপাদান হিসেবে যীশু নিস্তারপর্বের টেবিল থেকে একথা তুলেছিলেন। তাই, খ্রিস্টীয়ানদের কোন নেশা, বিয়ার বা মদ খাওয়ার ব্যাপারে ধর্মমাস্ত্রে তেমন কোন নিষেধাজ্ঞা দেয় নাই। বরং শাস্ত্রাংশ মদ খাওয়া সম্পর্কে ইতিবাচক ব্যাখ্যা দিয়েছে অনেক, যেমন-“তাই তুমি গিয়ে…আনন্দপূর্ণ অন্তরে আংগুর-রস খাও”। (উপদেশক ৯:৭ পদ ) তেমনি আমোষ ৯:১৪ পদে আলোচনা করা হয়েছে যে, নিজের আংগুর ক্ষেত থেকে (আংগুর-রস) মদ খাওয়া ঈশ্বরের আশীর্বাদের চিহ্ন। অবশ্য ঈশ্বর মানুষকে আদেশ দিয়েছেন যেন তারা মাতাল না হয় (ইফিষীয় ৫:১৮)। মাতাল হওয়া ও তার পরিণতিকে বাইবেল দোষ বলে গণ্য করে থাকে (হিতোপদেশ ২৩:২৯-৩৫)। বিপত্তিটা কোরঅনেই কেবল ব্যাতিক্রম হয়ে দেখা দিল। হাদিসে সরাসরি বলা হয়েছে ‘উম্মুল খাবায়েস’ অর্থাৎ সকল প্রকারের অনাচারের উৎস হচ্ছে মাদক। ‘শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতাও ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে ও সালাতে (নামাজে) বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’ (সূরা মায়িদাহ, আয়াত : ৯০-৯১) কারণ, যখন নেশার আবেগ উত্তেজনা বেড়ে যায়, তখন বাঘের ন্যায় হিংস্রতা প্রকাশ পায় এবং নৃশংস আচরণ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। অত:পর শূকরের ন্যায় আক্রমণ করতে উদ্যত হয় এবং সব শেষে দেহ অবস ও দুর্বল হয়ে পড়ে, তার নিদ্রা এসে যায় এবং সর্বাঙ্গ ঢিলে হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও (সূরা: বাকারা, আয়াত-২১৯ এবং সূরা নিসা, আয়াত-৪৩) এইসব আয়াত নাজিল হওয়ার পর তখন মদিনার লোকেরা মদের পাত্রগুলো ভেঙে ফেলে এবং শরাবখানাগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলে ইসলামী দেশে দেশে মদ্যপান একেবারেই কুরুচিকর বিষয়।

সে যাই হোক মদ্যপান নিয়ে বাড়াবাড়িরও কমতি-খামতি কম নেই। বাঙালির জীবনে মদ যদি কিছুটাও ‘স্বাভাবিক’ হয়ে থাকে, তা হলে তাকে ঘিরে ট্যাবুর রমরমা শুরু হল কবে থেকে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে ইংরেজ শাসন কায়েম হওয়ার কালে। কারণ, ১৯ শতকে একদিকে যেমন বাঙালি ব্র্যান্ডি বা শেরি খেতে শিখছে, তেমনই একই শাসনের উল্টো পিঠে ভিক্টোরীয় নৈতিকতায় সে তার বিরোধিতাও করেছে। মদ্যপান বিরোধী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ‘সধবার একাদশী’-র নিমচাঁদরাও ছিল, একথা ভুলে গেলে চলবে না। হুতোম তাঁর নকশায় লিখছেন-“আবগারীর আইন অনুসারে মদের দোকানের সদর দরজা বন্ধ হয়েচে অথচ খদ্দের ফিচ্চে না”। আবার বারে বসে নারী-পুরুষে একত্র পানাহার বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে সুলভ ছিল না। মোটামুটি ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত এই হাওয়া এদেশে বেশ বজায় ছিল। ‘কিন্তু বিশ্বায়ন-উত্তর পর্বে এই দৃষ্টিভঙ্গি টোটালি ঘাপলা হয়ে যায়। মদ একেবারে খুল্লমখুল্লা ধারায় বাঙালি জীবনে অনেকটা স্বস্তির হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ‘কুলীন’ মাতালরা যেমন তাঁদের মহিমা হারাচ্ছেন, তেমনই পেঁচি মাতালরা সমাজে ‘ওপেন’ হয়ে পড়ছেন। বড় বড় শপিং চেন চালু হলে চাল-ডাল-তেল-নুন মাসকাবারির পাশে হুইস্কি-ভদকা-ওয়াইনের পাশাপাশি কেরু এন্ড কোম্পানিও খুব লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

আরেব্বাস! এতোক্ষণ মদ্যপান বিষয়ে এতো যে মাতলামি বকর-বকর করলাম, তাতেই ভাববেন না যে- আমি বুঝি নেশায় চুর হয়ে আছি। না, মোটেই সে-রকম নয়, কারণ- পান-অভ্যেসে আমি কখনই গভীরতর কুয়াশার মতো স্বচ্ছ নই। মাতলামো স্বভাবও নেই। সে আমার বন্ধুরা আনেকেই জানে। ফলে, এক পেগে যেমন তেমন…বড়োজোড় ২/৩-পেগ খেয়েই হয়তো ঘুমস্বপ্নে টলকে যাই বিছানা বালিশ কিংবা ড্রইং রুমের সোফায়। এবং এ-ও তো জানি, এই একইভাবে এ-বছরও আমার ক্রিসমাস যথা নিয়মেই কাটবে।

অতএব…

সকল বন্ধুদের জন্য… ম্যেরী ক্রিসমাস এবং একপেগ চিয়ার্স…!

Related posts