মদসংখ্যা- জরিনা সুন্দরী ও খোয়ারিমঙ্গল ।। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
খোয়ারিগ্রস্থ প্রাতঃকাল। হিমের মধ্যে বসে থাকা মানবের শরীর জুড়ে রমণে ব্যস্ত মেয়েলোকের নিশ্বাসের উত্তাপ–ছিনালি রোদের আদর–অনুভব করতে-করতে হারিয়ে গিয়েও বেশি দূর যেতে পারলো না সে। সবটা উপভোগ্য হলো না–সহসা হানা দিল হাতে ধরা খামের ভেতর উল্লিখিত গুরুতর এক অভিযোগনামা। বলা হচ্ছে মানুষজন নাকি প্রমোদকর দিচ্ছে না ঠিকঠাক; রীতিমতো চালিয়াতি চলছে। এই কাতারে তার পাক্কা অবস্থান দেখে-শুনে-বুঝে মিলিয়ে দেখে নিজেকে এতদিন উপভোক্তা হতে অকস্মাৎ এক্ষনে ভুক্তভোগী হিসেবে পরিণতি ও দীর্ঘশ্বাসের ডালপালা। ইতোঃমধ্যে জনসংখ্যার ফাটাফাটি অবস্থা দেখে গরম হয়ে যৌন-সঙ্গমের উপরে প্রমোদকর বসিয়ে দেয়া হয়েছে উচ্চহারে। ঘোষণা আছে যে, দুইজনের বেশি সন্তান হলে বাঘ দিয়ে খাওয়ানো হবে। উরেব্বাপ রে! সে চোখে বাঘের পদচ্ছাপ দেখে!
এই সব সাত-পাঁচ ছাড়াও কথা আছে আরো এক কাঠি উদ্ধর্তন; কায়দা মেরে বলা হচ্ছে যে, সংগমযোগ্য নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে প্রমোদকরের ত্রিশভাগ তাদের পাওনা হিসেবে বর্তাবে। এক বসায় নারী-পুরুষ পঞ্চাশঃপঞ্চাশ কর দেবে এবং তার বাদে নারীমাত্র তিরিশ ভাগ ফেরত নিলে বাকিটা মুক্তির অর্থনীতি–নারীর অর্থনীতি।
মানব গুনে দেখে, মনে মনে, যে, বাস্তবে তার অনেক বকেয়া রীতিমত উদ্যত। পুরো ব্যাপারটিতে জনমিতি ও নারীনীতি মিলেমিশে একাকার, টাসকি মেরে গেছে জনগণের মধ্যে আরেক সে।
আইনে বিয়ের উল্লেখ নাই এবং বিয়েও করেনি মানব তবে কাম চালায় বলে আরেক স্ত্রী-লিঙ্গ মানবীকেও মেইনটেইন করতে হয়। কামকলার জন্য প্রকৃতি অনুদার তাই বড়ো দুর্বিপাক! ঘুপেঘাপে তেমন জায়গা নেই শহরে। চারিদিকে কংক্রিট–কোমলতার বড় আকাল। এটাই তার কাছে বড় সমস্যা।
মানবীর সঙ্গ এখন দরকার তার। পাশেই পড়ে আছে ফোনটা। সে বোতাম টিপল নম্বর অনুযায়ী। চোখ পর্দায়। অপেক্ষা করতে লাগল কখন মানবীর চেহারা ভেসে ওঠে।
রিং বাজছে। কিরিং… … কিরিং… … কিরিং… …
লিভিং রুমে নাই তো নাই বেডরুমে নাই, সে নাই ডাইনিং রুমে আরো নাই ড্রেসিং রুমে এমনকি রান্নাঘরেও।
কিরিং … কিরিং … কিরিং …
অবশেষে বাথরুমে
পর্দায় ভেসে ওঠা ছবিতে মানবীর দেখা পাওয়া গেল এবার। শুয়ে আছে বাথটাবে। হাত বাড়িয়ে বোতাম টিপে বলল, ‘হাই। কি মনে করে?’
মানবী তাকে দেখতে পাচ্ছে। সেও দেখতে পাচ্ছে মানবীকে। শরীরে সাবানের ফ্যানা। মানব এবার চোখের সামনে উপহার পেল এক জোড়া স্তন, ঠিক যেন বেলুন! ফুটে যাওয়ার পর গিট মেরে ফোলানো হয়েছে আবার, স্তন-বোঁটা দেখে তাই মনে হলো মানবের। ইচ্ছে হচ্ছে, পিন দিয়ে খোঁচা মারে, ফুটে যাক ফটাস করে–
মানব চুপ মেরে আছে দেখে ওপাশ থেকে মানবীর গলা, ‘কি ব্যাপার, চুপচাপ কেন?’
‘দেখছিলাম আর ভাবছিলাম’, বলল মানব। ‘কি?’ উৎসুক মানবী, ‘কোস্টার রকেটের কথা? আমাদের চাঁদে যাওয়া কদ্দূর? কবে যাচ্ছি?’
‘ওটা হয়ে গেছে। কিন্তু আমি ওর কথা ভাবছি না। ভাবছি সেই যন্ত্রটার কথা, ঐ যে কিছুদিন আগে যেটা বের হয়েছে।’
‘সেফ-টাচ’ নামে এক দারুণ যন্ত্র বের হয়েছে মাসখানেক হলো। সারা পৃথিবীতে অল্প কয়েকটা ছাড়া হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে। হাতের কাছে থাকলে এখনই মানবীকে স্পর্শ করা যেত! এই যন্ত্রের কার্যকারিতা এমনই যে একজন থেকে আরেকজনার দূরত্ব ছয় ইঞ্চির বদলে ছয় মাইল হলেও দিব্যি ‘কামবাড়ি’ দেয়া যায় ইমপালসের মাধ্যমে যেন ওয়াইফাই দিয়ে বিদ্যুৎ পাঠানো হচ্ছে। এখন মেশিন চড়া হলেও দিন গেলে দাম পড়বে। তখন ঘরে-ঘরে চলে যাবে; ছয়লাব হবে দেশমাটি একসময়।
মানবী সব বুঝে বলল হাসতে হাসতে, ‘বুঝতে পারছি, চাঁদে গিয়ে তোমার জ্বালাতনে টেকা যাবে না। যাক গে, তারপর চাঁদে যাওয়ার কথা বলো, ঢাকায় নিরিবিলি জায়গা না-পেয়ে সত্যিই ফেডআপ হয়ে গেছি।’
‘টিকিট কনফার্ম হয়ে গেছে। আমরা পরশু যাব। তুমি শাকান্নতে চলে এসো। বিকেল চারটায় রওনা হবো। যেতে আধঘণ্টা। আবার নয়টায় ফিরবো।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, পরে কথা হবে। এখন ছাড়ি। উম… উম… উম…’ ওপাশের মানবী।
‘উম… উম… উম…’, পাল্টা চুমু ছুঁড়ে দিল মানব মেশিন ছাড়া আর টাচ ছাড়া আরকি!
তখনো আর এখনো উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত দুইভাগ। সেখানে বিস্তর ফারাক। উচ্চবিত্তরা সবকিছু ইচ্ছেমতো ফাঁক করছে, আর মধ্যবিত্তরা আঙুল চুষছে, দেখছে আর তক্কে তক্কে আছে কবে একলাফে চলে যাবে ঐ পারে।
এই ‘মিডল ক্লাস’-এর উপর উল্টোপাল্টা হাওয়ার প্রকোপ জেগেছে। পেছনের প্রতি টান। প্রেমের ব্যাপারে। শোনা যায়, একসময় মানুষজন প্রেম করত পার্কে। ঠোঙাভর্তি এক টাকার বাদাম কিনে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে কাবার হয়ে যেত সারাদিন। মাঝে ফাউ হাত ধরা, ইতিউতি তাকিয়ে পচাৎ করে কম্পিত চুম্বন, সাবধানে কাপড়ের ফাঁক-ফোকর গলে তিন আঙুল দিয়ে বুকের-নিচে টেপাটিপি।
এখন মধ্যবিত্ত যুবক-যুবতীরা ঐভাবে প্রেম চায়। মানব-মানবীও আলাদা নয়। তবে এমনি ফ্রি সেক্স মামুলি ব্যাপার। বাপ-ছেলে পারলে এক প্যাকেট থেকে কনডম বের করে যার-যার পার্টসে লাগায়। মা মেয়ে একই বড়ি খেয়ে সময় মতো পিরিয়ড হলে স্বস্তিতে শ্বাস ফেলে।
আসলে মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে। একেবারে কুত্তাক্লান্ত অবস্থা। কিছুই আকর্ষণ করছে না। তাই পেছনের দিকে এই তাকানো। তবে শহরে এখন কোথাও আগের কায়দায় নিরিবিলি বসে প্রেমবাজি করার জায়গা নেই। সবখানে ক্যাওয়াজ আর কাউয়া ক্যাাচাল।
বোধ করি, চাঁদের পিঠে এখনও এইসব গোলযোগ ঢুকে পড়েনি হুড়মুড় করে। সেখানে লোকজন তেমন নাই বলে ধারণা প্রচার করে চন্দ্র ভ্রমণের আহবান আর রকমারি প্যাকেজ। মানুষেরা নাকি বেড়াতে যায় শুধু। মার্কিনিরা যায় তিরিশ সেকেন্ডে কিন্তু এদেশের লোকদের লাগে আধঘণ্টা-এমনটাই শুনেছে মানব। প্রভুদের গু-খেয়ে তোয়াজ করলেও অত তাড়াতাড়ি চাঁদে যাওয়ার বন্দোবস্ত সম্ভব হয়নি। মনিব আর চাকর কি এক থালে খায়?
চাঁদের সব খানাখন্দ ভরাট হয়েছে মাটি দিয়ে। এই মাটি সাপ্লাই করে বিনিময়ে জুটেছে চাঁদের সঙ্গে দেশের তাক লাগানো যোগাযোগ আর মাটি রপ্তানি বাবদ ফরেন কারেন্সি!
লোকজনদের চাঁদে যাওয়ার জন্য ব্যাংক থেকে উদার লোন দেয়া শুরু হওয়াতে চাঁদ এখন মামার বাড়ি। দেশের সঙ্গে চাঁদের উড়ন্ত যোগাযোগ চালু হতে-না-হতেই পৃথিবীতে অনাহারে মৃতু্হার লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ন্ত। বিষয়টি এখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে পরিণত বলে আওতায় চলে গেছে এমন ভাব বাগিয়ে সকলে বেশ নির্বিকার।
চাঁদে যাওয়ার রকেট সার্ভিসের দোতলা যানে উঠেই তার মেজাজ বুনসেন বার্নার। সসার সার্ভিস দুইঘণ্টা লেট। তারপর শুরু করলো যাত্রা।
চাঁদের পিঠে তৈরি আছে ফোয়ারা। ফুরফুর করে অক্সিজেন ছড়ায়। অক্সিজেন-ফোয়ারার এই ভেলকিতেই চাঁদে মৃদুমন্দ বাতাস। কায়দা করে মারা হচ্ছে লাল-নীল-বেগুনি আলো। বেশ এক রঙিন ঘোরের মধ্যে নর-নারী মাতোয়ারা। তবে বড্ড গা ঘেঁষাঘেষি। অক্সিজেন-ফোয়ারার পরিধির ভেতরেই সকলকে থাকতে হয়। একটু এদিক-সেদিক হলেই বিপত্তি। প্রেমিকার গালের বদলে নিতম্বে চুমু; ঊর্ধ্বাঙ্গ ধরতে নিম্নাঙ্গ আক্রান্ত। চুলের ঘ্রাণ নিতে গিয়ে অন্য চুলের কাছে নাক ঠেকে। রোমান্টিসিজমে ডান্ডি।পরিধির বাইরের অক্সিজেন শূন্যতা এজন্য দায়ী। তাতে মন্থরগতির ভাসান ঘটে।
চাঁদে নেমেই উচ্ছ্বাসের চোটে মানব আত্মহারা। পরিধি ঠাহর করে ওঠার আগে হাত ধরতে গিয়ে মানবীর পা ধরে ভ্যাবলা চ্যাকা। তবে দৃশ্যটিট দেখে ভারি চিত্তবিনোদিত হলো সঙ্গের পাবলিকের। টের পেল অক্সিজেনই জীবন। বিড়বিড় করে গালি চালাল আগের জামানার প্রেমিকদের। শালার পুত্র শালারা নাকি প্রেমে পড়ে নিবিড়ভাবে কাব্য করত চাঁদ নিয়ে। ব্যাটারা মরে-হেজে বেঁচে গেছে। নইলে ঐ ঘুঘুদের এখানে ধরে এনে ছেড়ে দিলে পাছার ছাল উঠে নুন লাগত, বাদাম খেতে হতো না আর।
সেই থেকে মুড অফ; টেপাটিপি করেও সুইচ অন করা গেল না। পুরো অভিসারে মাত্র তিনটি হাসি দিতে পারল বহুকষ্টে। ঠোটের বদলে পেটে আর চেষ্টা করে খানিক কচলাকচলি মোটে।ফলে চন্দ্রপৃষ্ঠ রমনরহিত করলো তাদের।
এইসব দারুণ অভিজ্ঞতা সম্বল করে মনের দুঃখ গলতে না-দিয়ে ফেরার পথে একজনের সঙ্গে আলাপ। ভদ্রলোক রাজনীতিক। প্রেমিকাকে এলোমেলো করতে নিয়ে এসেছেন চাঁদে।
লোকটি মানবের কাছে জানতে চাইল, ‘ক্যামন এন্জয় করলেন চাঁদ?’
‘আর বলবেন না, একটা চুমু পেলাম তা… …’ বলে ঠোঁটের বদলে নাভিকুণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করল সে। বাকি ঘটনা চেপে গেল সব।
লোকটি গলা ফাটিয়ে হাসি মেরে বলল, ‘আমার তো আরও ডেঞ্জারাস কাণ্ড। মেয়েদের ঘাড়ে চুমু খেতে বেশ লাগে। খেতে গিয়ে হোমোদের মতো ব্যাপার-স্যাপার। পাশের ভদ্রলোকের সঙ্গে জড়াজড়ি। তিনি লাভারের বদলে আমাকেই… … হাঃ হাঃ হাঃ… … আগে জেলে থাকতে এসব বেশ চলত… সেক্সের কষ্ট ভারি কষ্ট… … জেলখানায় এইভাবেই কাজ চলত… … হাঃ হাঃ হাঃ… স্মৃতি তুমি বেদনা…’
হাসি সংক্রামক। মানব-মানবীও এমত খিল্লির সঙ্গে যোগ দেয়।বেদনা মধুর হয়ে যায়।
দোতলা রকেটযান সাই সাই করে পৃথিবীপৃষ্ঠের দিকে ধেয়ে চলতে চলতে আচমকা ব্রেক কষে।মানব ঘটনা দেখতে উদগ্রীব হয়ে নিজেকে ব্যস্ত করতেই হুড়মুড় করে জানালা ভেঙে, –কি তাজ্জব–সে মহাশূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো। হাতপা ছুড়ে ভাসলো খানিকক্ষণ, –দ্রুত ধাবিত হলো পৃথিবীর পথে! মহাকাশ হতে সাঁতার কেটে দ্রুতবেগে নিম্নগামী সে ধরণীর বুকে আছড়ে পড়ার আগে শেষবারের মত দম ফেলে গত হয়ে গেল।
এ তো এক জঙ্গম! মরলে শহীদ, টিকলে গাজী। শহীদের স্বর্গবাস নিশ্চিত। সে নিজেকে শহীদ ঘোষণার জন্য কারো অপেক্ষা করল না।
এবার আসমানের গায়ে সেঁটে আছে বলেই তো মালুম হচ্ছে! তাই বুঝি পা উপরে, মাথা নিচে!
আরে! মশা কেন স্বর্গে? পুনপুন করে কামড় দাগাচ্ছে। যা-ব্বাবা!
ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখল। চেনা-চেনা লাগছে বেশ। চোখে পড়ে খালি বোতলের ছড়াছড়ি। হুরপরীরা নিশ্চয়ই শরাবনতহুরা সাপ্লাই করেছে। মাথা ঝাঁকাল সে। হাতে ধরা খালি বোতল নিয়ে ভাবল, কখন আবার মাল খেল সে! স্বর্গে কি মাল টানলে মনে থাকে না!
সে চাঁদি চুলকে ভেবে দেখল স্বর্গে গিয়ে মাল কথাটা মানাচ্ছে না। শরাব… হ্যাঁ… বেশ খাপ খাচ্ছে, হাঁফ ছাড়ল সে। নইলে আরেক পেঁচগি লাগত!
এবার বোতলটা ভাল করে দেখে তাজ্জব সে! স্বর্গেও জরিনা সুন্দরী! কীভাবে এই ‘বাংলা’ মার্কা শরাব সার্ভ করা হয়েছে, অ্যাঁ! ঈশ্বরের ক্রিয়েটিভিটি কি শেষ হয়ে গেছে!
আবার চারিদিকে ভালো করে দেখে। পরিচিত দৃশ্য : একদম মেথরপট্টি। স্বর্গ কি হয়ে গেছে দুই নম্বর মেথরপট্টি? সে-ও স্বর্গে এলো আর স্বর্গের কোয়ালিটি নামতে নামতে মেথরপট্টি! আসলে ঈশ্বর বোধহয় তাদের পৃথিবীর ঐ স্বর্গটাকে এখানে স্থাপন করে দিয়েছে। এই ভেবে তৃপ্তি পেল বেশ।
তারপর চকচকে চোখে সত্তরটা হুরপরী খুঁজতে লাগল মানব।
বি:দ্র: মদ খেলে জাত যায় সত্যি!জাত রাখিবার কী উপায়? মদ্যপানের আপদ-বিপদ বটে।
স্কেচ- স্নেহা দাস