কবিতা 

মদসংখ্যা- খোলা চোখে তাকিওনা ঘোলা হয়ে যাই ।। সাকিব শাকিল

কত পঁচনের পর তুমি যে বিষ হয়ে যাও বুকে?

-শরীরের ভেতরে আমার প্রতিক্রিয়া। তোমরা মানুষ কেন যে আমাকে বুকে রাখো শুধু জ্বলে যাওয়ার জন্য।

-আমরা তো তোমাকে গ্রহণ করে শীতল হয়ে উঠি। আমাদের বুক থেকে উড়ে যায় রঙবেরঙের পাখি। বোতলে বন্দি থেকে অসহ্য গুমোটে তুমি সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছো প্রিয়। আসো তোমাকে পান করি। পৃথিবীর হিম হাওয়ায় আমার বুকে জ্বলে ওঠো তুমি। আসো, প্রিয়তমা আসো।

– তাড়াহুরো করো না। সকল নির্যাসের পরেই থাকে জগতের ভ্রম। দ্যাখো, জগৎ মাতালেরা মেতে উঠেছে দ্রিম দ্রিম উৎসবের মাঝে। আর তোমার বিগতরা খিলখিল হেসে যাচ্ছে সরাইখানার দরজায়। তুমি কি কিছু টের পাচ্ছো হে মদিরা? সরাইখানার আলোতেও দেখো কতো মাতালের দুঃখ সমাবেশিত।

– আমি এক নরকের ঠিকাদার। তোমাকে নির্মাণ করেছি প্রতিটা গ্রহণের ভেতর। তুমি কি নির্মম কোমল! তোমার মমতার মাস্তানিতে আমি শিশু হয়ে গেছি। হে মদ, তুমি কি আমার স্কুলের বান্ধবী? তোমার শরীরের ভেতর আমি হারিয়েছি আমার খাতা-কলম। তোমার শরীর যেন অবারিত ভূমির প্রান্তর, আর এখানে আমি সমস্ত ফুল ফোটানোর দায়িত্বে নিয়োজিত।

-‘প্রকৃতি শুধু পাহাড় জন্মিয়েছে অবিরত। সেখানে ফুল ফোটানোর দায়িত্ব আমাদের।’

জগৎহারা মানুষ তুমি কেন যে জগতের জন্য পোড়ো।

ফুল ও ফলের বিয়োগে মহুয়াবনের বাতাসে যে মর্সিয়া বেজে ওঠে, তোমার পিতামহ তার কতটুকু জানে? মা মরা মদের কাছে কার যে অসুখ চুপ করে ঘুমিয়ে যায় হৃদয়ের ভেতর-আর হৃদয়ের আয়নায় যদি জমে উঠে কেলাসিত অভিযোগ তখন এই খোলা চোখ যেন ঘোলা হয়ে ওঠে। তাই খোলা চোখে তাকিওনা তুমি, আমি বারবার ঘোলা হয়ে যাই।

-এবার তবে দ্রাক্ষার কথা বলো। কোন বিরহের ধুধু পথ ধরে তুমি চলে আসো বুকে। তোমার শরীর জুড়ে শুধুই কি কাঁটা? প্রাচীন কোনো কবরের পাশে হয়তো জন্ম তোমার। কেননা তুমি কেবলি অন্ধকার। কেবলি অন্ধকারের বার্তাবাহক তুমি। তোমাকে দেখলেআমি অন্ধ হয়ে যাই। আমার নক্ষত্ররা ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু অন্ধকার জেগে থাকে। আর জেগে থাকি আমি। আমিও হয়তো অন্ধ হয়ে গেছি।

মদ, তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছো?

আমাকে শুনতে পাচ্ছো-হে মহুয়া মায়া?

এইতো আমি দাঁড়িয়ে আছি তোমার নিকটে, তোমার নিঃশ্বাসের পাশে দেখো হেটে যাচ্ছে আমার জীবনের কতো আয়োজন।

হেই মদ আর ইউ লিসেনিং টু মি? হেই প্রিয়তমা।

ছলনা করে সবাই ডাকতে জানেনা। সরাইখানার এই ঘন রাত্রিতে কত ধুলা যে হারিয়ে যায় বিষণè পথে পথে। আমরা কেউ কেউ তাই ফুল হয়ে উঠি, আমরা ডেকে উঠি করুণ মমতা নিয়ে, সমস্ত ক্ষত-বিক্ষত প্রান্তরে আমরা হয়ে উঠি জীবন নিঙড়ানো জল। আমরা তো কাঁটা হয়েই ফুটে উঠি তোমাদের হৃদয়ে। প্রতিটা গলাধঃকরণ জানে আমাদের আত্মহুতির কান্না। আর আমরা অভিশাপ দেই তোমাদের। তোমাদের ভেতরেও যেন ভর করে খালি বোতলের শূন্যতা।

-অপার শূন্যতা নিয়ে সত্যি বসে আছি। তুমি চলে আসো একটা পূর্ণতা নিয়ে। এই পাপ ও পঙ্কিলতা ঘিরে ধরেছে আমাকে। তুমি কি কোনো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা? জানিনা, তবু কেনো তোমার কথাই সত্য হয়ে ফুটে ওঠে এই ভুলের বাগানে। তুমি নিশ্চয় কোনো পরজনমের কাঠমিস্ত্রি। ধারালো অস্ত্র ছেনে ছেনে বয়ে যাও বুকের সেগুনকাঠে। আমরা সবাই মেশিনের মন নিয়ে ফেঁসে গেছি সরাইখানারকরাতকলে। তুমি হয়তো কোনো মৃত্যুর দালাল কিংবা কোনো ভৌতিক কথাবার্তা। তুমি চুপ করো প্লিজ। আমি ভয় পাচ্ছি।

তুমি চুপ করো প্লিজ, আমি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছি!

তুমি চুপ করো প্লিজ, আমি ভূত দেখতে পাচ্ছি!

আমি কি ভূত হয়ে গেছি নাকি ভূত আমি হয়ে গেছে!

তুমি কি আমি হয়ে গেছো নাকি আমি-তুমি (মদ) হয়ে গেছি!

আমি তো আনন্দ ও দুঃখের মাঝে সেতু হয়ে জন্ম নিয়েছি। এই সরাইখানা থেকে আমাকে আলাদা করতে পারে না কোনো মৃত্যু। আমি জীবনের দালালি করি মাঝে মাঝে দালালি করি প্রেমের। এত যে হৃদয়পোড়া ক্ষত নিয়ে তোমাদের শুশ্রুষা হয়ে উঠি তা জানে শুধু নিশাচর পাখিরা।

-এবার তবে উড়ালের কথা বলো। কোন কালান্তরের গহবর থেকে উঠে আসো তুমি? তোমার শরীর জুড়ে শুধুই কি পালক?

পালকের বাজারে আমরা পাখি হয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম বহুকাল। আমাদের বুক থেকে উড়ে গেছে অনেক পাখি ও পালক। সেই পালকের ঠিকানায় এই নিদ্রাহীন এই রাত ঢুকরে উঠে মর্মর স্মৃতিতে। রাতগুলো পাখি হয়ে উড়ে যায় আমার চোখের ভেতর দিয়ে। আমার চোখগুলো মাঠ হয়ে যায়। আমার চোখগুলো শৈশব হয়ে যায়। আমি হয়তো তোমার শৈশবের ভেতর কিঙবা সরাইখানার মাঠের ভেতর গোল্লাছুট দিয়ে হারিয়ে ফেলেছি আমার বাড়ি ফেরার ঠিকানা।

Related posts