কবিতা 

মদসংখ্যা- অতলান্ত ।। আতিকুর রহমান হিমু

‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা

মনে মনে মেলে দিলাম গানের সুরের এই ডানা’

সন্ধ্যাটা অন্যমনস্কো ভাবে হাঁটছে রাত্রির গভীরে। শুক্লা পক্ষের পথে পথে হলুদ বাদামি পাতা ও শীতবৃক্ষের ছায়া কঙ্কাল। ভাড়া বাড়ির তেতলার ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখের ওপর প্যান্টারালি আকাশ। অন্ধকারে হাবুডুবু করছে বিচিত্র সব রঙ। বিষণ্ণতা ছুঁয়ে আছে পাতাও নীড়ে ফেরা পাখিদের পালক। শৈশবে প্রায় বিকেলেই আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ফেরারি পাখিদের কোলায় ফেরা দেখতাম, পাখিদের ভিন্ন রঙ ভিন্ন স্বর জানা না জানা বিচিত্র সর্বনাম। আজও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় পাখিপাড়া বেড়াতে যাই। পাখি পাড়া কি সন্ধ্যে হয়? মেঘ করে? বৃষ্টি নামে? জলসা জমে? পাখিদের গানের ক্লাসে পাখিকন্যারা স্বরলিপির খাতা নিয়ে আসে! এভাবেই পাখিপাড়ার গলি উপগলি পেরিয়ে চলে যাই দু’দশক আগের কোন এক সন্ধ্যায়। সম্পা আন্টির মেঘ কন্ঠে জলজমে, রূপকথা সাঁঝে ঝরে ঝরে পরে গীতবিতান ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জে¦লে দিবস গেলে করবো নিবেদন- আমার ব্যাথারপুঁজা হয়নি সমাপন’ অদ্ভূত তন্দ্রার ভিতর তন্ময় হয়ে শুনছি আমি, চুপকথার সেই সন্ধ্যা থেকে আমার বুকের ভিতর পালক মেলে রবীন্দ্রনাথের বানীবনের হংসমিথুণ, সুর। আজও ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা আমি স্তব্ধ চাপারতরু গন্ধ ভওে তন্দ্রা হারা’। অন্ধকারে আন্ধকার বাঁক নেয়, বাঁক নেয় গল্পও; অতীত থেকে অতলে। অন্ধকারে জেগে ওঠে ডুমুরের ফুলের মতো যতযত জোনাক মুখ। উঠান কোণে ভাপাপিঠার উনুন। কেউ কেউ হাত ছেকে নেয় সোনালী উত্তাপে। পিতাময়ীর শরীর-শাড়ি ও শাল থেকে বেরুচ্ছে উষ্ণতার সুভাস, সেই সাথে ঝরছে তাঁর ব্যক্তিগতগন্ধ। অন্যসবার শরীর থেকেও উড়ছে বাষ্প অথচ প্রত্যেকের গন্ধ আলাদা। একটাগল্পে তাদের ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠস্বর। চিবুকের রঙ ভিন্ন অথচ তাঁরা সামষ্টিক। ছোট ছোট ব্যাথা আর সুখের হাট বসে উনুনের পাশে। টুকরোটুকরো স্বপ্ন আর কান্না হাসি তারা ছেকে নেয় সোনারঙ আগুনে। তিন আঙুলে পরগ করে একটা ভাপাপিঠা নামিয়ে রাখা হয় বাঁশচেরির বুননে বুনা চালনিতে। সবুজ শৈশব একটুকরো পিঠা নিয়ে ছুটে যায় উঠনের অন্য কোণে। দৌড় খোলা, জ্যোৎস্নায় মেঘ ও ময়ূর ময়ূর গোল্লাছুট। দক্ষিনের পুকুরটার পারে ছাতিম ফুলের মাতাল গন্ধ। গল্পের মতো ঘাসের উপর ঘুমিয়ে আছে ঝরা পাপড়ি, তবু যাওয়া বারন। কেন! ভূতের সবগল্পের ল্যান্ডস্কিপ। ছাতিম ফুল বিছানো পুকুরটার পারে কে যেন সেই কবে বুনে রেখেছে আছরের ভয় কথা। তবু ডাক দেয় মলয়বাতাস; পা চলেযায় পুকুর পারে, এনিয়ে দাদীর কত হৈ চৈ। একটা দুধশাদা খয়েরী চোখের পায়রা ওড়ানো হয় গা মুছিয়ে। পায়রাটা মুক্তিপায় কুসংস্করনের ব্যাকরণে। টোটেমযুগের রূপকল্পে উড়তে থাকে দিগন্তের আঁছর নিয়ে। একটা হোগলায় বসে আমাদের আমাদের সম্মিলিত শৈশব। রূপকথা থেকে লোককথা, ছড়া থেকে কিস্ছা ধাঁধার গোলকে চুপকথায় গল্প বাঁক নেয় অন্ধকারে, অন্ধকারের বায়ান্ন বাজার ও তার তিপান্নটি গলিতে। সেই সব গলি উপগলি ঘুরে আমাদের মন চলে যায় দক্ষিণ পুকুরের পারে। আবার শুরু হয় পুকুর ছোঁয়া সব আশ্চার্য গল্প। আমাবশ্যা রাতে পাঠার গায়ের গন্ধ নিয়ে বেড়াতে আসে ভূত। তেঁতুলের ডালে ডালে জ্যোৎস্নায় ভিজে ভিজে নাচে চাঁদের দেশের পরীরা। ডানায় চেপে বাচ্ছাদের অচিনপুরে নিয়ে যাবে পরী, পরীর দেশের কল্পচিত্রে রাতবারে শীতবারে, মগজে রিদম তোলে সেই কবেকার মধুমালা ও মদনকুমার। গা ছমছম করে আবার ভালোও লাগে, আকাশ বেড়ানোর ইচ্ছে জাগে। পরীর দেশের কল্পচিত্রে রাতবারে শীতবারে। উনুনের আগুন মজে যায়, ভাপাপিঁঠার গন্ধ মুছেদেয় পেঁৗষ বাতাস। কুয়াশায় ঘোলাচাঁদ ঝিমুতে থাকে, ঘুমের পর্দা নামে লেপের ওমে। ‘ফিরে এসো ফিরে এসো- বন মোদিত ফুলবাসে। আজি বিরহরজনী ফুল্লকুসুম শিশির সলিলে ভাসে।’ আদুরে ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে, দুরে লাল আলোর সংকেত। ছাদ থেকে স্পস্ট দেখা যায় শহরের ক’টা গলি উপগলি। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে কয়েকটা পাতাছেঁড়া কলাগাছ আর আনেকগুলোর বাড়ির ছায়া নিয়ে ঘুমিয়ে আছে জীবনানন্দের শহরের পথ। একদিন এমন সজীব জ্যোৎস্নার পথ ধরে আমরা হাঁটছিলাম শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের দিকে। দুর্দান্ত লিজা আপু আলমিরা ভাঙে পেরে আনে ফুল পাখি, কখনো বা আমাকে তুলে দেয় গাঢ় খয়েরী বনেতীফুল। আর আমি নাজুক বিকেল জুড়ে চুপচাপ দেখি পাতাদের ঝরে পরা, হেমন্তের হলুদ , মাছেদের ঘাই দেয়া, পরাগায়নের বনে প্রজাপতির গোল্লাছুট। তখনও আমি স্কুল পর্বে পা রাখিনি; মায়ের মুখে মুখে ছড়া কাঁটি ‘বনের পাখি ডাকাডাকি করছো কেন বনে/ সোনার খাঁচায় এসো তুমি রাখবো স্বজতনে/ কঁচি কঁচি মিষ্টফল তোমায় দিবো খেতে/ সন্ধ্যে হলে বিছানা পেতে ঘরে দিবো শুতে।’ লাজুক সেই শৈশবে কেন জানি ভালো লাগতো দুর্দান্ত কিশোরীর দুরন্তপানা। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। আনেকদিন পরে লিজা আপু এলেন, সাথে তার সম্পর্কের বোন। নাম মনে নেই রূপকথা বালিকার, আমার বয়সের আথবা একটু বেশি। আমি তখন ক্লাশ ফাইভ। জ্যোৎস্না ডাগর চোখে ঘরের কোনে ঝরা বকুলের মতো জড়ো হয়ে বসে আছে চুপকথার অচেনা অতিথি। টিউবয়েল নেই নানাবাড়িতে তখনও। জলের কলস খালি রেখে বিকেল বেলা চলে যায় সুমির মা। শেষ পর্যন্ত ছোট্ট রূপালি কলস নিয়ে বেরুতে হলো আমাকে সাথে চুপকথার মেয়ে। জ্যোৎস্নার আল্পনাময় পথ ধরে ভরা হলো জলের কলস। আমি তুলতে পারছিলাম না, অতিথি বললো দাও -হাফছেড়ে বাঁচলাম। ঠিক দরজার কাছে এসে কলসটা নামলো ও, ভিতর ঘরে এসে বললো বাব্বা ও পুরটা পথ কলসটা নিলো, বললো তুমি অতিথি। মিথ্যাটা আমি মেনে নিলাম, সত্যিটা হারিয়ে গেলো হলুদ পাতায়। জ্যোৎস্নার ভিতর আমাদের গল্প হলো: ইশ্কুল, মাঠ, নদী, মাছ, ছবি আঁকা আর গল্পের গল্প। তারপর প্রায় দু’দশক পেরিয়ে। জ্যোৎস্না ভেজা তেতলার ছাদের চুপকথায় বারে স্মৃতি স্মতি অসুখ। অসুখ বাঁক নেয়; একটা সিপসিপে নদী ঠিক চন্দ্রা নামের মেয়েটার মতো। চন্দ্রাকে আমি জানি না, গতকাল বিকালে জীবনবাবুর শহরে একটা নীল রঙ প্লাজু পরে ঘুরেছিলো, কেন জানি মনে হলো ও চন্দ্রা। ধনুকের মতো বাঁকা কালো নৌকা রূপালি জল ভেঙে ভেঙে আসছে নগরের দিকে। পিছনে পরে আছে ম্যাম্পির চোখের মতো ডাগর সবুজ চর। স্বপ্নের মতো সরিষাফুলে ভরা মাঠ, আঁকাবাঁকা আলপথ, বিকেল ডানায় মেখে একঝাঁক হলুদ পাখির উড়ে যাওয়া, চুপচাপ বসে থাকা বক, টলমলে জলে মাছেদের ঘাই। ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে এককী শঙ্খচিলের ঝিল ধরা ডানা। মলয়বাতাসে বকুলের বিহব্বল করা ঘ্রাণ। আমরা যাচ্ছি নগরের দিকে, ঝড়ঝাপ্টায় নৌকাটা লাফাচ্ছে সফং-সফাং শব্দে। ফানাতোলা অজগরের মতো হিস্ হিস্ করছে বাতাস।

সন্ধ্যাটা অন্যমনস্কো ভাবে হাঁটছে রাত্রির গভীরে। শুক্লা পক্ষের পথে পথে হলুদ বাদামি পাতা ও শীতবৃক্ষের ছায়া কঙ্কাল। ভাড়া বাড়ির তেতলার ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখের ওপর প্যান্টারালি আকাশ। অন্ধকারে হাবুডুবু করছে বিচিত্র সব রঙ। বিষণ্নতা ছুঁয়ে আছে পাতাও নীড়ে ফেরা পাখিদের পালক। শৈশবে প্রায় বিকেলেই আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ফেরারি পাখিদের কোলায় ফেরা দেখতাম, পাখিদের ভিন্ন রঙ ভিন্ন স্বর জানা না জানা বিচিত্র সর্বনাম। আজও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় পাখিপাড়া বেড়াতে যাই। পাখি পাড়া কি সন্ধ্যে হয়? মেঘ করে? বৃষ্টি নামে? জলসা জমে? পাখিদের গানের ক্লাসে পাখিকন্যারা স্বরলিপির খাতা নিয়ে আসে! এভাবেই পাখিপাড়ার গলি উপগলি পেরিয়ে চলে যাই দু’দশক আগের কোন এক সন্ধ্যায়। সম্পা আন্টির মেঘ কন্ঠে জলজমে, রূপকথা সাঁঝে ঝরে ঝরে পরে গীতবিতান ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জে¦লে দিবস গেলে করবো নিবেদনÑ আমার ব্যাথারপুঁজা হয়নি সমাপন’ অদ্ভূত তন্দ্রার ভিতর তন্ময় হয়ে শুনছি আমি, চুপকথার সেই সন্ধ্যা থেকে আমার বুকের ভিতর পালক মেলে রবীন্দ্রনাথের বানীবনের হংসমিথুণ, সুর। আজও ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা আমি স্তব্ধ চাপারতরু গন্ধ ভওে তন্দ্রা হারা’। অন্ধকারে আন্ধকার বাঁক নেয়, বাঁক নেয় গল্পও; অতীত থেকে অতলে। অন্ধকারে জেগে ওঠে ডুমুরের ফুলের মতো যতযত জোনাক মুখ। উঠান কোণে ভাপাপিঠার উনুন। কেউ কেউ হাত ছেকে নেয় সোনালী উত্তাপে। পিতাময়ীর শরীর-শাড়ি ও শাল থেকে বেরুচ্ছে উষ্ণতার সুভাস, সেই সাথে ঝরছে তাঁর ব্যক্তিগতগন্ধ। অন্যসবার শরীর থেকেও উড়ছে বাষ্প অথচ প্রত্যেকের গন্ধ আলাদা। একটাগল্পে তাদের ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠস্বর। চিবুকের রঙ ভিন্ন অথচ তাঁরা সামষ্টিক। ছোট ছোট ব্যাথা আর সুখের হাট বসে উনুনের পাশে। টুকরোটুকরো স্বপ্ন আর কান্না হাসি তারা ছেকে নেয় সোনারঙ আগুনে। তিন আঙুলে পরগ করে একটা ভাপাপিঠা নামিয়ে রাখা হয় বাঁশচেরির বুননে বুনা চালনিতে। সবুজ শৈশব একটুকরো পিঠা নিয়ে ছুটে যায় উঠনের অন্য কোণে। দৌড় খোলা, জ্যোৎস্নায় মেঘ ও ময়ূর ময়ূর গোল্লাছুট। দক্ষিনের পুকুরটার পারে ছাতিম ফুলের মাতাল গন্ধ। গল্পের মতো ঘাসের উপর ঘুমিয়ে আছে ঝরা পাপড়ি, তবু যাওয়া বারন। কেন! ভূতের সবগল্পের ল্যান্ডস্কিপ। ছাতিম ফুল বিছানো পুকুরটার পারে কে যেন সেই কবে বুনে রেখেছে আছরের ভয় কথা। তবু ডাক দেয় মলয়বাতাস; পা চলেযায় পুকুর পারে, এনিয়ে দাদীর কত হৈ চৈ। একটা দুধশাদা খয়েরী চোখের পায়রা ওড়ানো হয় গা মুছিয়ে। পায়রাটা মুক্তিপায় কুসংস্করনের ব্যাকরণে। টোটেমযুগের রূপকল্পে উড়তে থাকে দিগন্তের আঁছর নিয়ে। একটা হোগলায় বসে আমাদের আমাদের সম্মিলিত শৈশব। রূপকথা থেকে লোককথা, ছড়া থেকে কিস্ছা ধাঁধার গোলকে চুপকথায় গল্প বাঁক নেয় অন্ধকারে, অন্ধকারের বায়ান্ন বাজার ও তার তিপান্নটি গলিতে। সেই সব গলি উপগলি ঘুরে আমাদের মন চলে যায় দক্ষিণ পুকুরের পারে। আবার শুরু হয় পুকুর ছোঁয়া সব আশ্চার্য গল্প। আমাবশ্যা রাতে পাঠার গায়ের গন্ধ নিয়ে বেড়াতে আসে ভূত। তেঁতুলের ডালে ডালে জ্যোৎস্নায় ভিজে ভিজে নাচে চাঁদের দেশের পরীরা। ডানায় চেপে বাচ্ছাদের অচিনপুরে নিয়ে যাবে পরী, পরীর দেশের কল্পচিত্রে রাতবারে শীতবারে, মগজে রিদম তোলে সেই কবেকার মধুমালা ও মদনকুমার। গা ছমছম করে আবার ভালোও লাগে, আকাশ বেড়ানোর ইচ্ছে জাগে। পরীর দেশের কল্পচিত্রে রাতবারে শীতবারে। উনুনের আগুন মজে যায়, ভাপাপিঁঠার গন্ধ মুছেদেয় পৌঁষ বাতাস। কুয়াশায় ঘোলাচাঁদ ঝিমুতে থাকে, ঘুমের পর্দা নামে লেপের ওমে। ‘ফিরে এসো ফিরে এসো- বন মোদিত ফুলবাসে। আজি বিরহরজনী ফুল্লকুসুম শিশির সলিলে ভাসে।’ আদুরে ল্যাম্পপোস্ট জ¦লছে, দুরে লাল আলোর সংকেত। ছাদ থেকে স্পস্ট দেখা যায় শহরের ক’টা গলি উপগলি। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে কয়েকটা পাতাছেঁড়া কলাগাছ আর আনেকগুলোর বাড়ির ছায়া নিয়ে ঘুমিয়ে আছে জীবনানন্দের শহরের পথ। একদিন এমন সজীব জ্যোৎস্নার পথ ধরে আমরা হাঁটছিলাম শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের দিকে। দুর্দান্ত লিজা আপু আলমিরা ভাঙে পেরে আনে ফুল পাখি, কখনো বা আমাকে তুলে দেয় গাঢ় খয়েরী বনেতীফুল। আর আমি নাজুক বিকেল জুড়ে চুপচাপ দেখি পাতাদের ঝরে পরা, হেমন্তের হলুদ , মাছেদের ঘাই দেয়া, পরাগায়নের বনে প্রজাপতির গোল্লাছুট। তখনও আমি স্কুল পর্বে পা রাখিনি; মায়ের মুখে মুখে ছড়া কাঁটি ‘বনের পাখি ডাকাডাকি করছো কেন বনে/ সোনার খাঁচায় এসো তুমি রাখবো স্বজতনে/ কঁচি কঁচি মিষ্টফল তোমায় দিবো খেতে/ সন্ধ্যে হলে বিছানা পেতে ঘরে দিবো শুতে।’ লাজুক সেই শৈশবে কেন জানি ভালো লাগতো দুর্দান্ত কিশোরীর দুরন্তপানা। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। আনেকদিন পরে লিজা আপু এলেন, সাথে তার সম্পর্কের বোন। নাম মনে নেই রূপকথা বালিকার, আমার বয়সের আথবা একটু বেশি। আমি তখন ক্লাশ ফাইভ। জ্যোৎস্না ডাগর চোখে ঘরের কোনে ঝরা বকুলের মতো জড়ো হয়ে বসে আছে চুপকথার অচেনা অতিথি। টিউবয়েল নেই নানাবাড়িতে তখনও। জলের কলস খালি রেখে বিকেল বেলা চলে যায় সুমির মা। শেষ পর্যন্ত ছোট্ট রূপালি কলস নিয়ে বেরুতে হলো আমাকে সাথে চুপকথার মেয়ে। জ্যোৎস্নার আল্পনাময় পথ ধরে ভরা হলো জলের কলস। আমি তুলতে পারছিলাম না, অতিথি বললো দাও -হাফছেড়ে বাঁচলাম। ঠিক দরজার কাছে এসে কলসটা নামলো ও, ভিতর ঘরে এসে বললো বাব্বা ও পুরটা পথ কলসটা নিলো, বললো তুমি অতিথি। মিথ্যাটা আমি মেনে নিলাম, সত্যিটা হারিয়ে গেলো হলুদ পাতায়। জ্যোৎস্নার ভিতর আমাদের গল্প হলো: ইশ্কুল, মাঠ, নদী, মাছ, ছবি আঁকা আর গল্পের গল্প। তারপর প্রায় দু’দশক পেরিয়ে। জ্যোৎস্না ভেজা তেতলার ছাদের চুপকথায় বারে স্মৃতি স্মতি অসুখ। অসুখ বাঁক নেয়; একটা সিপসিপে নদী ঠিক চন্দ্রা নামের মেয়েটার মতো। চন্দ্রাকে আমি জানি না, গতকাল বিকালে জীবনবাবুর শহরে একটা নীল রঙ প্লাজু পরে ঘুরেছিলো, কেন জানি মনে হলো ও চন্দ্রা। ধনুকের মতো বাঁকা কালো নৌকা রূপালি জল ভেঙে ভেঙে আসছে নগরের দিকে। পিছনে পরে আছে ম্যাম্পির চোখের মতো ডাগর সবুজ চর। স্বপ্নের মতো সরিষাফুলে ভরা মাঠ, আঁকাবাঁকা আলপথ, বিকেল ডানায় মেখে একঝাঁক হলুদ পাখির উড়ে যাওয়া, চুপচাপ বসে থাকা বক, টলমলে জলে মাছেদের ঘাই। ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে এককী শঙ্খচিলের ঝিল ধরা ডানা। মলয়বাতাসে বকুলের বিহব্বল করা ঘ্রাণ। আমরা যাচ্ছি নগরের দিকে, ঝড়ঝাপ্টায় নৌকাটা লাফাচ্ছে সফং-সফাং শব্দে। ফানাতোলা অজগরের মতো হিস্ হিস্ করছে বাতাস। ফস ফস করে নামছে ভয়ংকর বৃষ্টিধারা। আমি শক্তকরে ধরে থাকি মায়ের নীলপারে শাড়ির আঁচল। ঝড় থামে মা গাঢ় সবুজ রঙের এক টুকরো গ্রাম হয়ে যান। আমি ছুটি নগরের সন্ধানে। অকস¥াৎ নাগরিক মাঝরাতে তেতলার ছাদে লাল রাবার বলের মতো লাফাতে থাকে আমার শৈশব। দুরের লাল আলোর দিকে তাকাই; সেই দ্বীপ? আমার শৈশব, আলো বিকেলের গোল্লাছুট, কুয়াশা ঢাকা মাঠ, ভোরের মক্তব, রোদ সকালের সাকো, সাঁকোর ওপারের স্কুল। ছাগল ছানার নাম পুটু, বেড়লটাকে ডাকি মিনি বলে, কানকাটা মহিষ, হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট কুকুরটার রঙ কালো। ধানের গন্ধ, ঝিঁঝিঁ ধরার ছড়া, কলাই ফুল, শিশির মাখা নীল কলাইর ফুল। ওগো কলাইর ফুর? শুনতে পাই জলে ভেসে গেছে, জলে ভেসে গেছে আনেক কাল আগে। আমার জন্মভিটা, প্রথম চিৎকারে মাতৃজঠর থেকে নেমে ছুয়ে ছিলাম যে মাটি? নদী, নিজের করে নিয়েছে। হয়তো এখন ডুবোচর হোগলা কাশের বন। কৈশরের লাল লাটিম, মৃত বলাকার পালক, হলুদ পাখিটা কি সত্যিই বেনেবউ? ইা স্কুল ছুড়িপর্ব নেই আমার। পাগলদাদার বিলপুকুরে ভাসতে থাকা হাঁস, ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ, উত্তর পুকুরের পারের মাটির ভিতর মাছরাঙাদের সংসার। ভাঁটফুল, সাঁকো, ইশকুল, লালঘুড়ি, সাতচারা, গোল্লাছুট, এক্কাদোক্কা, ইচিং বিচিং সিচিং ছা প্রজাপতি উড়ে যা, বউছি, কানামাছি, গল্পের ক্লাশ, পিঠারঘ্রাণ…

‘দক্ষিণ সমীরে দুর গগনে একলা বিরহি গাহে বুঝি গো।/

কুঞ্জবনে মোর মুকুল যত আবরণ বন্ধন ছিঁড়িতে চাহে।’

সংগীতময় মধ্যরাতে একটা ট্রেন থামে। নয়’শ কামরার ট্রেন। উঠেপরি চালকবিহীন নিঃসঙ্গ ট্রেনে। আমিই একমাত্র যাত্রি। ট্রেনটা উঠতে থাকে চাঁদ বরাবর সূর্য বরাবর সন্ধ্যা তারা ভেদকরে উঠতে থাকে ঈশ^রের নিজস্ব রেঁটিনার শূণতা বরাবর। তারপর চক্রাকারে ঘুরে নেমে আসে সমতলে। নুনজল অতিক্রম করে নেমে পরে সমুদ্রের গভীরে। সমুদ্রের তলদেশ ছুঁয়ে নামতে থাকে আরো গভীরে, অতলের অতলে; খনিজ স্বপ্নের অতল অতলন্তে…

 

স্কেচ- হিম ঋতব্রত

Related posts