কবিতা 

মদসংখ্যা- ‘ধন্য আমি ধন্য হে মাতাল তোমার জন্য হে’ ।। টুম্পা ধর

পৃথিবীর যেকোনো সৌন্দর্যকে অবাধে ছোঁয়া নিষিদ্ধ করার চিন্তা থেকেই হয়তো অমৃত সমান একটা বিশেষ পানীয়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সমাজ সংসারে বিশেষ বিশেষ আবিষ্কারগুলোকে বেশ কড়া নিরাপত্তায় সযত্নে আগলে রাখা হয়। কারন অতিমাত্রায় যেকোনো জিনিস তার অস্তিত্ব হারায়। মানুষও তার উর্দ্ধে নয়, তাই যেকোনো বিশেষ পরিবেশে মানুষ নিজে নিজেকে আগলে রাখে, সেই সঙ্গে আরও যে সকল বস্তুকে আগলে রাখে তার মধ্যে মদ বা বিশেষ পানীয়ও অন্যতম। তাই মদকে কেন নিষিদ্ধ করা হলো, তা নিয়ে ভেবে আমার কখনো মন খারাপ হয় না।

স্বচ্ছ কাচের বোতল হোক আর গ্লাস কিংবা শখের মাটির হাড়ি- এবং তার মধ্যে থাকা বিচিত্র পানীয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকেই মূলত এ লেখার প্রতি আগ্রহ। গাঢ় খয়েরি, সোনালী, কালো, স্বচ্ছ, ঘোলাটে এত সব বাহারি রঙের পানীয়ের সাথে জড়িয়ে আছে মানুষের কতশত হাসি কান্নার গল্প-গান, ভালো লাগা-খারাপ লাগার মুর্হূত! খুব ছোটবেলা থেকেই আমার বাবার অভিজাত চালচলনের কারনে বাসায় একটা অন্যরকম রাজকীয় আমেজ খেয়াল করতাম। টেলিভিশনে হিন্দি আর ইংরেজি সিনেমায় অভিজাত আতিথেয়তায় কিংবা বিলাসি জীবনে যেসব গ্লাস আর বোতলের সমারোহ চোখে পড়তো- তার অনেকটাই আমাদের বাসার শোকেসেও শোভা পেতো বলে মনে মনে একটা অন্যরকম অহংকার কাজ করতো। কিন্ত শোকেসে আকর্ষনীয় গ্লাসগুলো শোভা পেলেও বোতলগুলো বাবার কর্মচারির হাত ধরে চলে যেতো আমার বুক শেল্ফের পেছনের একটা জায়গায়। আমার কৈশোরী কৌতূহলী মন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো আর নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করতো কেন এই বোতলগুলিকে নিয়ে লুকোচুরি খেলা চলে! বোতলের প্রতি মায়ের মান-অভিমান দেখে বুঝতে পারতাম এসব জিনিষ নিষিদ্ধ, এসব নিয়ে কথা বলা মানা। কিন্তু বুঝতে পারতাম এসব পানীয়ের প্রতি বাবার একটা বিশেষ ভালোবাসা আছে। সপ্তাহে এক-দুই দিন বাবা উনার মূল্যবান সময় থেকে বিশেষ কিছু সময় ওই বোতলের পানীয়ের জন্য উৎসর্গ করতেন। মান্না দে, হেমন্ত মূখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মূখোপাধ্যায়, লতা মুঙ্গেশকরের গান বাজতো কখনো মৃদু শব্দে। বাবা একা একা বসে এই বিশেষ মুহূর্ত বেশ উপভোগ করতেন তা বাবার চেহারা দেখেই বোঝা যেত। আমিও পাশে বসে উপভোগ করতাম সেই মুহূর্ত, বাবা মাঝে মাঝে তার জীবন যুদ্ধের গল্পগাঁথা বিলাপ করতেন। আবার কখনো কখনো তার কিশোর-যৌবনের নানান গল্প বলে মাকে ক্ষ্যাপাতেন। আমি ধ্যান-মগ্ন হয়ে উপভোগ করতাম সেইসব মুহূর্ত। আমি অপেক্ষায় থাকতাম সপ্তাহে কোন দিন বাবা আবারো এই বিশেষ পানীয় নিয়ে বসবে! বাবা ওই বিশেয় পানীয় গ্রহণের দিনগুলোতে আমার পড়ার চাপ কমে যেত, কারণ আমি আমার আজীবনের শিক্ষক মেজবোনকে দেখাতাম আমি বাবার পাশে বসে পড়ছি। আসলে পড়ালেখা সেদিনের মতন স্বর্গবাসী হতো। আর আমি তো কেবল মাখানো চানাচুর, বিস্কুট আর পোড়া পোড়া কে ভেজে রাখা মাছ-মাংসে মজে থাকতাম।

আমি বছর বছর বড় হতে লাগলাম আর বাবা ভাবতো ছোট মেয়ের বয়স কখনোই বাড়ে না। আহ্লাদে আমার পা মাটিতে পড়ে না আর মুখ দিয়ে স্পষ্ট কথাও বের হয় না। দিদিরা আমার এই আদিখ্যাতায় ক্ষেপে গিয়ে বাবাকে নালিশ করে আর বাবা বলে থাক ও ছোট কিছু বলিস না। কিন্তু এভাবে আমার ভিতরের আহ্লাদ দুঃসাহসে পরিনত হতে থাকে।

একবার একটা সুবর্ণ সুযোগ হাতে চলেই এলো। কোন এক শুক্রবার সন্ধ্যায় বাবা মাত্রই কেরুর হুইস্কির মুখ খুলেছে, ঠিক তখনই আমাদের জুয়েলারি দোকান থেকে কেউ একজন এসে বাবাকে কি যেন বললো। বাবা সেই বাসার লুঙ্গি-ফতুয়াতেই বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে ইশারায় বলছিল আমি যেন বোতলটা তুলে রাখি। এই সরল বিশ^াস জিনিসটা যে খারাপ তা আমি আজও বিশ^াস করি। বাবা যাওয়ার সাথে সাথে আমি বোতলটা যেই-না তুলে রাখতে যাবো, ঠিক তখনই আমার সরল-ছোট্ট মন মৃদু হেসে উঠলো। মনে মনে হয়তে বোতলকে বললাম ‘ডোন্ট ওরি ডিয়ার, বাবা নাই তো কি হয়েছে মেয়ে তো আছে!’। এদিক ওদিক তাকিয়ে গ্লাসে খানিকটা ঢেলে নিতেই মা কেন যেন ডাকলো। আমি তড়ি-ঘড়ি করে বোতল সরাতে গিয়ে খেয়াল করলাম বাবা তো ভরা বোতল রেখে গিয়েছিল! তাই বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে পানি মিশিয়ে শূণ্যস্থান পূরণ করে বোতল জায়গামতন রেখে দিলাম। তারপর গ্লাসে ঢালা সেই পানীয় গলায় ঢেলে দিলাম। মা ওইদিকে ডেকেই চলেছে। এদিকে পানীয় গিলে তো আমার চোখ ভর্তি জল। কি এক অদ্ভুত ঝাঁঝে গলা ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন। আমার একমাত্র শিক্ষক মেজ বোন এল বাটি ভর্তি করে মাত্রই ভেজে উঠানো আলুর পাপড় নিয়ে। ও এসেই আমার অবস্থা দেখে কাতর হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী হইছে কান্না করছিস কেন? আমি তো মহা বিপদের সাগরে ডুবতে যাচ্ছিলাম বুঝতে পেরে ওকে কিল-ঘুসি মেরে চিৎকার দিলাম- কুত্তা তোর কাছে পড়বো না, তুই যা। ও এতই শান্ত স্বভাবের ছিল যে, আমাকে শান্ত করতে মুখ বুজে চলে গেল। আর এদিকে আমি ওই ভাজা পাপড় খেতে খেতে ঝিমুতে লাগলাম। গভীর রাতে যখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম, তখন আমি চেয়ার টেবিল ছেড়ে বিছানায়। মা কিছুটা উদ্বিগ্ন, চিন্তিত হয়ে আমাকে ডেকে তোলার চেষ্টা করছে। সেটাই ছিল আমার প্রথমবার মদ্যপানের গল্প। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ভয়ে ছিলাম। কিন্তু ভাগ্য এতোটাই ভালো ছিলো যে, কি যেন একটা পারিবারিক ঝামেলায় কেউ আর আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে নি। তবে আমি শুধু সুযোগ সন্ধানে থাকতাম, যদি আরেকদিন সেই ঝাঁঝ নিতে পারতাম!

তারপর এক বৃহস্পতিবার রাতে বাবা মারা গেলো। শুক্রবার বাবা মদের আসরে হাসলো না, গান বাজলো না, খাবার টেবিলে এলো না কোনো সুন্দও খাবার, শুধু চিতার আগুনে বাবা জ্বলে গেলো।

এই সমাজে মদ্যপান একটা ট্যাবু বা নিষিদ্ধ ঘটনা। আর সেখানে মেয়ে হলে তো কথাই নেই। মদ কিংবা বিশেষ পানীয় অপছন্দ করে এমন মানুষ যদিও মেলানো কঠিন। তারপরেও কেন এই বিশেষ পানীয়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার ওপর কেউ গবেষণা করেনি। এমন ভাবনায় একটা বিশাল মদবিহীন দিনকাল পার করতে থাকেলেও, কী একটা অদৃশ্য নেশাতুর সময় আমাকে সব সময়ই ডাকতো।

হঠাৎ করে জীবনে আলো ছড়াতে দেবদূত হয়ে এলো এক মদদদাতা বা মদদ দানকারী, যাকে ভালোবেসেই জীবন এগিয়ে গেলো। আমরা বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে সবার সাথে মিলে-মিশেই এই বিশেষ পানীয় অর্জন করি। তবে আমাদেও দু’জনের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় মদবিহীন মন্ত্রপাঠে তার কেমন লেগেছিল তা কখনো তাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। কিন্তু বিয়ের আসরে বসে আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলাম আমি। সেদিন মন খারাপ নিয়ে মনে মনে ভাবছিলাম, আজ বাবা থাকলে আমাদের এই বিয়ের আসর নিশ্চই মদহীন হতো না।

বাংলাদেশে মেঘালয় গারো পাহাড়ের পাদদেশ বিস্তৃত জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিং, নেত্রোকোনা সুনামগঞ্জ হয়ে সিলেট পর্যন্ত । যেখানে বাংলাদেশী গারোদের বাস। এর বাইরেও আছে টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলের গারো অঞ্চল। সেখানে গারো সমাজের ঐতিহ্যবাহী পানীয় ‘চু’-এর সাথে পরিচয় ঘটেছে বিগত বছরগুলোতে। সে এক ভিন্ন জগৎ। বাঙালি সমাজে মদিরার প্রতি যে বিধিনিষেধ, লুকোচুরি- গারো সমাজে সেটি অকল্পনীয় ব্যাপার। চু বা মদিরা না খাওয়াই বরং সেখানে অস্বাভাবিক। মান্দি বা গারো সমাজের সকলপ্রকার উৎসব আয়োজন ছাড়াও কোনো রকম উপলক্ষ ছাড়াই নিজেদের হাতে বানানো এই চু যখন তখন আনন্দ উপলক্ষ বয়ে আনে।

আমাদের পরম আশ্রয়ের ঠিকানা হালুয়াঘাটের ঠাকুরদার বাড়ি। ঠাকুরদা ও দিদিও বাড়িতেই প্রথমবার সেই স্বাদু পানীয়ের সাথে পরিচয়। ভিন্ন এক স্বাদ, নতুন এক অনুভূতি, একদম প্রকৃতির কোলে বসে তুরা পাহাড়ের চূড়া দেখতে দেখতে বিশেষ পানীয়ের মমতায় জড়িয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল এই যাত্রায় মরে গেলেও কোনো আপত্তি নেই। এরপর গারো যত বন্ধু-স্বজনদেও বাড়িতেই গেছি কমবেশি সেই অভিজ্ঞতাই নাড়া দিয়েছি মনে।

সেবার বড়দিনে হালুয়াঘাটে, দাদার বাড়িতে পুরো রান্নাঘর আমার হাতে। ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দাদা ও সঞ্জয় পিঠা বানানোর সরঞ্জাজামাদি এনে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। দাদাদের আত্মীয়-স্বজন এসে উঠানে চু নাড়াতে বসে গেল। আমি আর দিদি পিঠা বানাচ্ছি অতিথী আপ্যায়ন করছি- আর সবাই মিলে চু খাচ্ছিলাম। গারো সমাজের নারী-পুরুষ, অর্থ-বর্ণ নির্বিশেষে এই যে মিলনমেলা, আত্মার টান- যা আমাকে বার বার ডাকে। আমি আবারো ফিরে যেতে চাই সেই সব আদরণীয় সন্ধ্যায়।

এরপর আমাদের বাসায় নিজ হাতে বেশ কয়েকবার গারো চু বানানোর অভিজ্ঞতা হয়েছে। চু পানের ব্যাপারে গালো সংস্কৃতি রক্ষণশীল না হলেও, চু তৈরিতে যে আচার নিয়ম নীতি অনুসরণ করা হয়, তা বেশ রক্ষণশীল। কেননা চু গারো সমাজের ঐতিহ্য। একটা নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনাকে সম্মানের সাথে ধারণ করা খুবই সংবেদনশীল ব্যাপার। আর প্রথম প্রথম চু বানিয়ে গারো বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল। তবে সৌভাগ্যবশত প্রথমবারেই স্বাদে-গন্ধে উনিশ-বিশ হলেও কাজে ঘটেছিলো একদম দশে-দশ। সে জন্য মনে মনে আমার বেশ গর্বও অনুভব হয়।

কর্মক্ষেত্রেও এটা আমার পরম সৌভাগ্য যে পিতৃসম বসের সাথে বসেও পানীয়ের সমাবেশে হেঁটে অনায়াসে সময় পাড়ি দেয়া যায়। যদিও ট্যাবু ধারণকারী এমন দৃশ্য অনেক সহকর্মীই মেনে নিয়ে নির্দ্বিধায় এখনও গিলে খেতে পারে না। তাদের গলা ছিঁড়ে যায়, আর গিলে খেলেও বদহজমে বমি হয়ে যায়। আমার কাছে এসব ঘটনা সুখভোগ্য।

মদ কিংবা কোমল পানীয়- যে নামেই ডাকি না কেন, সমস্ত জীবন এর সাথে পথ চলতে আমার কোনো আপত্তি নেই। সারাদিনের ঝড়-ঝঞ্ঝা এড়াতে কিংবা আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে এই পানীয়ের আড্ডার জুড়ি নেই। জীবন চলমান, এই চলার পথে কেউ যদি জীবনকে উপভোগ করার পথ খুঁজে পায়, তবে এই সমাজ সংসারের ক্ষতি কী তাতে?

মানুষ যখন মদ খায়, সব ঠিক থাকে। কিন্তু মদ যদি মানুষকে খাওয়া শুরু করে তখনই না কেবল ঝামেলা শুরু হয়। নতুবা মদ তো এক মহান পানীয়ই। জীবনের ব্যাথা-বেদনাকে মুহূর্তে অসার করে দিতে কিংবা আনন্দের মাত্রাকে সূক্ষ্ম থেকে আরও সূক্ষতায় নিয়ে যেতে মদিরার জুরি নেই। পৃথিবীর সকল সমাজে, সকল গোত্রে তাই আবিষ্কৃত হয়েছে বিচিত্র মদিরা। বিচিত্র তার উপাদান আর নির্যাস। দেশে দেশে এর রঙ, গন্ধে বৈচিত্র থাকলেও পান করার পর নিমিষেই সীমানা উধাউ।

আমরা জীবনকে মূল্য দিয়েই উপভোগ করি। খুব ছোট এই জীবন যাত্রায় কখনো উত্থান, কখনো পতন আসে। এই ছোট্ট জীবনের সমস্ত সুষমা নিতে মদে মাতাল হয়ে কষ্টকে ভুলে থাকতে কিংবা আনন্দের বন্যা বইয়ে দিতে আমি বার বার মাতাল হতে চাই। পরম করুনাময় ঈশ^রের কাছে আর্জি আপনার নিষিদ্ধ তালিকা থেকে সুপেয় এই লাল-নীল পানিয়কে নির্দ্বিধায় অবমুক্ত করুন।

Related posts