গদ্য প্রবন্ধ 

ইতিহাসে আরমানিটোলা মাঠ।।আহমেদ মুনওয়ার মাহবুব

আরমানিটোলা মাঠ নিছক মাঠ নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপুর্ণ ঘটনার সাক্ষী এই মাঠ। এই মাঠের গল্প বলার আগে আমরা আমরা একটু পেছনে চলে যেতে চাই।  ষোল শতকের   আর্মেনিয়া পারস্যের সাফাভি রাজবংশের অন্তর্ভুক্ত হলে আর্মেনিয়ানরা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৮ শতকে মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ঢাকায় তাদের আগমন। ঢাকায় তখন কাঁচা পাটকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বানিজ্য সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো। ঢাকা থেকে নদীপথে কাচা পাট পাঠানো হতো কলকাতায় । ঢাকার পাটকে ঘিরে কলকাতায় গড়ে উঠেছিলো বড়  বড় সব জুটমিল। তাই পাটের ব্যবসায় মন দিয়েছিলেন ঢাকার আর্মেনীয়রা। আব্রাহাম পোগজ, এম ডেভিড, জে সি সারকিস, জে জি এন পোগজ, মাইকেল সারকিস, পি আরাতুন পাটের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। ব্যবসায়িক সাফল্যের কারণে তারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে স্থানীয় লোকদের মুখে এই এলাকার নাম হয়ে ওঠে আরমানিটোলা। ঢাকায় চলাচলের জন্য আরমেনীয়রা চালু করেন ঘোড়ার গাড়ি, যা কালক্রমে ‘ঠিকাগাড়ি’ হিসেবে পরিচিত ছিলো। সময়ের সাথে ঢাকার অভিজাত শ্রেণীর চলাচলের প্রধান যানবাহন হয়ে ওঠে এই ঠিকাগাড়ি। এই ঠিকা গাড়ি, ঘোড়া, ঘোড়ার খাওয়ার জন্য পানি, খাদ্যসামগ্রী রাখা হতো এ মাঠটিতে। বিশ শতকের শুরুর দিকে নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে এই মাঠটিকে খেলাধুলা করার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয় ।

পরবর্তীতে এই মাঠটি পুরান ঢাকা তথা বাংলাদেশের  রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ন্যতম কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। আমাদের আলাপের বিষয় এই মাঠটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে । আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গেও । অনেক ঐতিহাসিক সভা ও রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সাক্ষী আরমানিটোলা ময়দান।

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার কেএম দাশ লেনেররোজগার্ডেনে  এক গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মী সম্মেলনের প্রথম দিনই স্বতন্ত্র একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ জন্ম হয়। ২৪ জুন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় আরমানিটোলা মাঠে। এ জনসভায় একটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে, মুসলিম লীগের গুন্ডারা বাদশা মিয়ার নেতৃত্বে জনসভায় আক্রমণ ও ভাঙচুর চালায়। কিন্তু জনসভার বক্তৃতা  শোনার বাদশা মিয়ার বোধোদয় হয় তিনি বলেন,  ‘আজ থেকে আমি আওয়ামী লীগের সভ্য হলাম, দেখি আরমানিটোলায় কে আপনাদের সভা ভাঙতে আসে?’

১৯৪৯ সালে দেশে খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করে। এর প্রতিবাদে সে বছরের ২০ আগস্ট আরমানিটোলা ময়দানে ভাসানির সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তৃতা করেন আতাউর রহমান খান, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান। জনসভায় মওলানা ভাসানী বলেন, জনাব লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসছেন অক্টোবর মাসে, আমরা তাঁর সাথে খাদ্য সমস্যা ও রাজবন্দিদের মুক্তির ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চাই। যদি তিনি দেখা না করেন আমাদের সাথে, তাহলে আমরা আবার সভা করব এবং শোভাযাত্রা করে তাঁর কাছে যাব।’ এর পরপরই খবরের কাগজে প্রকাশ পায় ১১ অক্টোবর লিয়াকত আলী খান ঢাকা আসবেন। এ সময় মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানকে টেলিগ্রাম করতে বলেন যাতে তিনি ঢাকায় এসে তাঁদের সাথে দেখা করেন। টেলিগ্রাম পাঠানো হয় মওলানা ভাসানীর নামে। লিয়াকত আলী খান এই টেলিগ্রামের কোনো উত্তর দেননি। শুধু তাই নয়, তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কি তিনি জানেন না।’ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে লিয়াকত আলী খানের দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকায় ১১ অক্টোবর আরমানিটোলা ময়দানে আবারো সভা করা হয়। সভায় সবার বক্তৃতা শেষে পূর্ব-ঘোষণা অনুযায়ী বের হয় শোভাযাত্রা । পরবর্তী সময়ে এ শোভাযাত্রা ভুখা মিছিলে রূপ নেয়। মিছিল পুরনো ঢাকার নাজিরাবাজারে পৌঁছলে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও লাঠিচার্জ শুরু করে। এতে অনেক নেতাকর্মীর সাথে আহত হন শেখ মুজিবুর রহমান। একই সাথে গ্রেপ্তার হন শামসুল হকসহ অনেক নেতাকর্মী।

১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ একটি জনসভার আয়োজন করে আরমানিটোলা ময়দানে। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে ওই জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো অনেক আওয়ামী লীগ নেতা বক্তব্য রাখেন। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি নিয়ে আন্দোলন চলছিলো। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ৫ ডিসেম্বর বন্দি-মুক্তি দিবস উপলক্ষে আরমানিটোলা ময়দানে এক বিরাট জনসভা করা হয়। জনসভা আয়োজন করে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ। সভার সভাপতিত্ব করেন পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান। বক্তৃতায় সবাই রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এবং বাংলাকে অবিলম্বে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। একই কারণে ১৯৫৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আরমানিটোলা ময়দানে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে আরেকটি জনসভা হয়। এই জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বন্দি-মুক্তি ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বক্তব্য রাখেন।

এর পরপরই কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে  জনমানুষের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। ঐদিন শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর পর একটি মিছিল বের করা হয়। শেষে আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় একটি জনসভা। সভায় লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি সভাস্থল পেরিয়ে আশপাশের এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। ‘শহীদ-স্মৃতি অমর হোক’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে  আরমানিটোলা ময়দানের চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠেছিলো সে-দিন। আরমানীটোলা মাঠ এভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। তবে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে  ঐতিহাসিক এই মাঠটি ধূলাবালি আর ইটের স্তুপে পরিনত হয়েছে। নেই বিন্দুমাত্র দূর্বাঘাসের ছোঁয়া।

তথ্যসূত্র:

১. নূহ-উল-আলম লেনিন। ২০১৫। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল। ঢাকা। সময় প্রকাশন। পৃষ্ঠা ২৭, ২৯। ২. শেখ মুজিবুর রহমান। ২০১৪। অসমাপ্ত আত্মজীবনী। সুলভ প্রথম সংস্করণ। ঢাকা। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। পৃষ্ঠা ১২১, ১২২, ১২৮, ১২৯, ১৩০, ১৩২। ৩. মুনতাসীর মামুন। ২০২০। বঙ্গবন্ধুর জীবন জেল থেকে জেলে ১৯৫০-১৯৫৫। ঢাকা। অনন্যা। পৃষ্ঠা ১৭। ৪. বশীর আলহেলাল। ১৯৯৯। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। দ্বিতীয় বর্ধিত আগামী সংস্করণ। ঢাকা। আগামী প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৫৭৯, ৫৮১, ৫৮৪। ৫. এম আবদুল আলীম। ২০১৯। ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল। ঢাকা। আগামী প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৪১, ৪৭।

Related posts