গদ্য প্রবন্ধ 

আর্চার কেন্ট ব্লাড।। আহমেদ মুনওয়ার মাহবুব

আর্চার কেন্ট ব্লাড বাঙালিদের কাছে সুপরিচিত তার ব্লাড টেলিগ্রামের মাধ্যমে । মার্কিন কূটনীতিক আর্চার কেন্ট ব্লাড ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কনসাল জেনারেল নিযুক্ত হন। যদিও এর আগে ষাটের দশকের শুরুতে তিনি ঢাকায় কূটনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ব্লাড ছিলেন মার্কিন সরকারের সাথে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগের সূত্র। পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতা বন্ধে মার্কিন সরকারকে ব্লাড যে কঠোর ভাষায়  টেলিগ্রামটি পাঠান তা ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে খ্যাত।

১৯৭০ সালের মার্চে ব্লাড যখন ঢাকায় আসেন তখন সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছিলো। দূতাবাসে বসে নির্বাচন পর্ব পর্যবেক্ষণ করাই ছিলো ব্লাডের কাজ এবং সেই অনুযায়ি হেডকোয়ার্টারে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠানো। হোয়াইট হাউস থেকে তাঁকে শুধু চলমান পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে বলা হয়েছিলো। নির্বাচনের পর ক্ষমতাহস্তান্তরে  পশ্চিম পাকিস্তান টালবাহানা শুরু করলে তিনি টেলিগ্রাম মারফত নিজের দেশের সরকারকে জানান। সে-সময় বেশ কয়েকবার শেখ মুজিবের সঙ্গে ব্লাডের বৈঠক হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের পর ৩০ ডিসেম্বর এক বৈঠকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা তথা বাংলার পরিস্থিতির অবনতি শুরু হলে শেখ মুজিব সংকট সমাধানের জন্য মার্কিন প্রশাসনের সাহায্য চান। শেখ মুজিবের পক্ষ হয়ে মার্কিন তেল কোম্পানি এসোর  পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার আলমগীর রহমান আর্চার কে ব্লাডের  সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আলমগীর রহমানকে দিয়ে শেখ মুজিব মার্কিন দূতাবাসে প্রস্তাব পাঠান, বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারীর ভ‚মিকা পালন করবে কি না। দূতাবাসের হয়ে আর্চার ব্লাড জানান, তাঁর সরকার চায় পাকিস্তানের ঐক্য টিকে থাকুক। তবে সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত। ব্লাড আরো বলেন, মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করা হবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার শামিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের এটি করা উচিত হবে না। ১২ ফেব্রুয়ারি স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো এক বার্তায় রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, কনস্যুলেট জেনারেল আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিকে মধ্যস্থতা করার ব্যাপারে অপারগতা জানিয়ে ঠিক কাজটি করেন। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের কোনো অংশের বিচ্ছিন্নতা চায় না এবং পাকিস্তান টিকে থাকুক এটিই আশা করে।

লেবাননের সংবাদপত্র ‘টাইম লাইফ’-এর সংবাদদাতা ড্যান কগিন ১৯৭১ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারি সকালে আর্চার ব্লাডডের সঙ্গে দেখা করেন। আগের দিন বিকালে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর এক ঘণ্টা কথাবার্তা হয়। মুজিব তাঁর মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসনের মনোভাব জানতে চান। জানতে চান, ছয় দফার ভিত্তিতে একটি সংবিধানে সম্মতি দেয়ার ব্যাপারে ইয়াহিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র চাপ প্রয়োগ করতে রাজি হবে কি না। যদি তা না হয়, তাহলে একজন নামমাত্র প্রেসিডেন্টের অধীনে দুটি সংবিধানের মাধ্যমে দুটি প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান একটি কনফেডারেশন আকারে থাকতে পারে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়াকে রাজি করাবে কি না। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের জবাব ওইদিনই শেখ মুজিবের কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা। এ সময় আর্চার ব্লাড তাঁর আগের অবস্থানই আবার তুলে ধরেন, যা তিনি এর আগে আলমগীর রহমানকে বলেছিলেন। ১ মার্চ বেলা ১টায় রেডিওতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেয়া হয়। পরিস্থিতি যে দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছিলো, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ওয়াশিংটনে অবস্থিত পররাষ্ট্র দপ্তরে ঢাকার কনস্যুলেট থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, ‘ঘূর্ণিঝড়ের আগে পাকিস্তানের ঐক্য বজায় থাকার সম্ভাবনা ছিলো ৫০ : ৫০। নির্বাচনের পর এ সম্ভাবনা ঐক্যের বিরুদ্ধে ৭৫ : ২৫ অনুপাতে হেলে পড়ে এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেয়ার পর ঐক্যের সম্ভাবনা এখন ০ : ১০০’। গ্যারি জে বাসের বরাত দিয়ে বলা যায়, ‘’ঢাকায় তখন পাঁচশর মতো মার্কিন নাগরিক বসবাস করে। শহরটা ক্রমেই এ আমেরিকানদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। ‘পাকিস্তানি সেনাদের বিদেশীবিরোধী কার্যক্রম’ দেখে সচকিত ব্লাড তড়িঘড়ি তাদের দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিলেন। পরে তিনি পররাষ্ট্র দপ্তরকে বলেন, ‘পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন হত্যা আর লুটপাট করে, গুলি করতে মুখিয়ে আছে সবাই। তাদের হাতে এখনো কোনো আমেরিকান নিহত বা আহত হয়নি, এ এক বিস্ময়।’ নিজের পরিবার নিয়ে উদ্বেগে ছিলেন ব্লাড। মেগ ব্লাডও মোটেই নিরাপদ বোধ করছিলেন না তাদের সরকারি বাসভবনে। তিনি স্মরণ করেন, ‘আমাদের বাসার ভেতরেও গুলি এসে লাগত।’’’ ব্লাড খুব সচেষ্ট ছিলেন এই গণহত্যার বিরুদ্ধে । তিনি মানবিক বিবেচনাবোধকে কখনোই ছোট করে দেখেননি। তিনি জানতো তার পাঠানো বার্তাগুলো মার্কীন প্রশাসন খুব ভালোভাবে নিবে না। এবং তাকে গোপনীয়তার ক্ষেত্রে যে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয় তিনি সেসবের ব্যাপারেও কিছুটা উদাসীন ছিলেন । কারন তিনি চাচ্ছিলেন এই গণহত্যার খবর পৃথিবীবাসী জানুক।

ব্লাডের পাঠানো গোপন তারবার্তাগুলো এতো বেশি গোপন রাখতে বলা হয়েছে যেন  প্রশাসনের ভেতরের লোকজনের কাছে ও না পৌছে কিন্তু পররাষ্ট্র দপ্তরের সকল চেষ্টা সত্ত্বেও সরকারি লোকজনের বাইরে ব্লাডের ‘নির্বাচিত গণহত্যা’ শিরোনামের বার্তাটি কয়েক দিনের মধ্যেই গণমাধ্যমের হাতে চলে গেল। শুধু তা-ই নয়, কেউ একজন ব্লাডের পাঠানো কয়েকটা বার্তা বিরোধীদলীয় সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির হাতেও পৌঁছে দিল। ওই তারবার্তাগুলোর ভিত্তিতে কেনেডি সঙ্গে সঙ্গে আবেগপূর্ণ এক ভাষণে (পূর্ব পাকিস্তানে) মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য নিক্সন প্রশাসনকে তাগিদ দিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ব্লাডের এই বার্তাকে সুনজরে দেখেনি। তাঁকে একপর্যায়ে ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে ফিরিয়ে নেওয়া হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে। কিন্তু ব্লাড মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে যে ধাক্কা দিয়েছিলেন, তা নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্রের জন্য ছিল চপেটাঘাত। ব্লাড সেই সময়ে মার্কিন প্রশাসনের নলে রোষানলে পড়লেও পরবর্তীকালে তার কাজের জন্য নন্দিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁকে ক্রিশ্চিয়ান এ হার্টার অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেন। ঢাকায় আমেরিকান সেন্টারের লাইব্রেরির নামও রাখা হয় তাঁর নামে: আর্চার কে ব্লাড লাইব্রেরি।

Related posts