তানভীর হোসেনের দশটি কবিতা
কেমন জানি লাগতেছে
বিকাল নামতেছে বাগানে বাগানে
তবু যাওয়াদের সবাই কি ফিরতেছে?
অনেক দূরে হুদাই মেঘের তাউরাশিতে
কেউ না কেউ তো ঠিক মরতেছে!
আইলসা চোতের বিকালটারে তোমার
ঠাণ্ডা সোডা গিলতেছে তো গিলতেছে
বিড়ালগুলা বড়ই গাছের ছায়ার ভিতর
আপনমনে খেলতেছে তো খেলতেছে
পিচ্চি দুইটা হলুদ প্রজাপতি তাদের
ঘিরে উড়তেছে, এসব দেখে আমার
জানি কেমন কেমন লাগতেছে!
সেনার সারির মতোন রাবার গাছে
পেয়ালাগুলা ঝুলতেছে, কি জানি কে যে
কোন এক ফাঁকে সেসব ফাঁকা করতেছে!
আমি খালি ছবিগুলার পেছন হাঁটা
ত্রাসের ভেতর কাঁপতেছি, আমি খালি
অন্ধকারে ঐ ছবির ভিতর মরতেছি
তাও তো বিকাল নামতেছে, একলা ভীষণ
গোখরাটারও কেমন জানি লাগতেছে।
রেনট্রি
একটা রেনট্রি নিয়া কবিতা লিখতেছি আমি, বাতাসে দুইলা ওঠা প্রেমিকার চুলের মতো সে মাঝেমাঝে দুইলা উঠতেছে। তার নিচে একটা কাবাবের দোকান, বিশাল তাওয়ার উপর কাবাবওয়ালার খুন্তির মেলোডিয়াস শব্দ পাওয়া যাইতেছে। আর উপর দিয়া বইয়া যাইতেছে বেওয়াফা মেঘ- উত্তরে, যমুনার দিকে অথচ রেনট্রিটা কিছুই কইতেছে না। রেনট্রি কখনই কিছু বলে না। বলে না ক্যান?
তুমি কইলা তুমি মৃত
আমি কইলাম, আমিও তো
আমরা মিশলাম আমাদের ভিতর
তুমি ভাবলা তুমি কি এখনও আছো আগের মতো?
আমি ভাবলাম একটা লোকের কথা, রিকশাওয়ালা,
পলিথিন ছিঁড়ে পড়ে যাওয়া তার চাইলের কথা- রাস্তায়
তারপর তুমি চইলা গেলে আমি ভাবলাম আমাদের কথা
একা একা, ভাবলাম আমাদের ক্যান হইলো দেখা এক্ষণে ক্যান আমি তোমারে তোমার ব্যাপার রেখে কইলাম সিনামার কথা, ট্রাভেলার, ক্লোজ-আপ, দ্যা উইন্ড উইল ক্যারি আস কিংবা
দ্যা সাইক্লিস্টের কথা, ক্যান কইলাম জীবনের মানে এক কাপ চা
কিংবা অন্য কিছু
তুমি কইলা তুমি যাবা
আমি কইলাম না কিছু
তুমি গেলা, যাওয়ার সময় তোমার জামা আটকায় গেল দরজার হাতায়
খুলতে গিয়া তাতে বেকায়দায় ধাক্কা খাইলা তুমি, পাইলা পাঁজরে ব্যথা
আমি কইলাম আসো ভিতরে আসো
ক্যান জানি মনে হয় জমা আছে আরও
অগুনতি সময়ের কথা আমাদের ভিতর
চুপচাপ বসে বসে
আজকে ভরাট চাঁদ
আজকে জোয়ার বা ভাটা
আজ আমার গ্লাস ভরা তুমি
আজকে আমি সারায় দিতে পারি
তোমার ব্রহ্মাণ্ড সমান ব্যথা।
মূলত
পাখির ভাবনায় কি আছি আমি? এমন বাতুল প্রশ্নের ভিড়ে তুমি স্পর্শের অভাব নিয়ে প্রশ্ন করো। মূলত আমার আর তেমন কিছুই বলার নেই যেমন ছিল বিগত শীতগুলোয় কিংবা তারও আগে। এভাবেই স্মৃতির উৎসার, বিস্মৃতির উৎসব, প্রিয় সবার ম্রিয়মাণ হয়ে আসা। যা কিছু ব্যাখ্যাতীত ব্যথার চূড়ান্তেও তদ্রুপ ফেলে রাখা ভাল, কে আছে বুঝেছে অপরের ভাষা? ঋতু বদলের খেয়ালে কি আছি আমি কিংবা ঝরা পাতা, ফুলের মুকুল এইসব নিতান্ত ক্লিশের ভেতরেও? উত্তুঙ্গ আসরের প্রতিবেশে যা বলে চেঁচালো মদখোর- তাতে? ফলে আমি আমাকে ছড়ালাম ব্রহ্মাণ্ডে, বিশ্লিষ্ট হলাম বর্তমান প্রতিটি কণিকায়, মাটির অক্ষরে লেখা হল দেখি তুমি। তবুও ঘনিষ্ঠতা আরাধ্য নৈঃশব্দের মতো কেবলই রয়ে গেল দূরে, বৃথা গেল জলের কিনারে বসে জল পরিমাপ। ভাবি একদিন নিজের এতদসংক্রান্ত দিনপঞ্জি তোমাকে দেখাই, দেখাই মানুষের বোধহীন মেরুদণ্ডে নির্মিত সাইকির কারাগার। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় এসবের কীইবা বুঝবে তুমি? শরীরে শরীর মিশে গেলে জগতে কত কি না ঘটে যায়- যুদ্ধ, হলোকাস্ট, মহামারি… অনাকাঙিক্ষত বিচ্ছেদ!
ন্যুয়ান্স
নিরর্থক নীহারিকা এক যারে কখনও দেখি নাই
শুধু কোন শব্দ বা শব্দরূপে তার ঢুকে পড়া শীতের শালবনে, অস্ফূট সন্ধ্যার দিকে, কুয়াশার জন্মদিন ও লৌকিক এলাকাসমূহে আর বাধা পড়ে যাওয়া।
কথা কওয়া মনে মনে নির্ভার- নিঃসংকোচ কিন্তু
কে শোনে কারে? নদীর নিহিল স্রোতে ভাসমান
বেশ্যার লাশ এতোটাও সশব্দ কী! অনেকটা ন্যুয়ান্সের মতো বরং যেন হাতুড়ি ও পুরানো পলেস্তারা বা পাখি ও পাখির পালক।
আসো যাই পৃথিবীর দিকে, এদিকে মাঝিদের গায়ে ফুটে ওঠা বেতবন, তারে ফালাফালা গরম সুরুজ, গাং চিরে ধাবমান ডিঙ্গি- টুপ করে ডুবে যায় বেশ্যার লাশ- প্রান্তরে
সাক্ষাৎ জ্বলছে আগুন লেলিহান, তোমার চুলের ভেতর যে বিলি এখনও কাটিনি আমি সেটুকুই প্রেম, বাদবাকি খামাখা অ্যাস্থেটিকস, আমাদের ধাবমান ডিঙ্গিখানি হোক বিপ্লবের সকল সর্বনাম। মূলত আরেকটু দূর আমাদের সীমারেখা, লক্ষণরেখার মতো যেন কিছু ঘটে যাবে লঙ্ঘনে, কাঁচে কেটে যাবে পা আর রক্ত- রক্তেই কেটে যাবে অধীনতা, গ্রে এরিয়ার সামগ্রিক সংকট, তর্ক ও তার্কিক আর প্রিয়তম অবসাদগুলি হেসেখেলে অবলীল। মূলত আরেকটু দূর আমাদের হেঁটে যাওয়া ছিল ভাল, নিজেদের বাধ্যবাধকতাগুলি আবিষ্কারের পর ঠিকরে পড়া অহং সব ম্রিয়মান হয়ে এলে বসে থাকা ছিল সেথা, অবিকল না হলেও অনেকটা মানুষের মতো হয়তো ছোঁয়ার চেষ্টা করা যেতো নিজেদের মজ্জাগত সন্ত্রাস।
তোমার-আমার
একটা মুহূর্তের ভেতর জোর করে বসে থাকি ।
মেদবন, ট্যানারি হতে ব্যাপ্ত মনোহর প্রচারণা,
বিদ্রূপাত্মক দিন, বিমূঢ় রাত, প্রকাণ্ড পাকুড়ের ছেলেভোলানো কৌশলে ধাতস্থ হল, এমন মুহূর্তের
ভেতর আত্মরতির মতো ধ্যান, বিস্ফারজ্যোতি,
উচ্ছ্বাস বাস করে। কোত্থেকে নাযিল হয় এই
প্রমিতির মেঘ, বর্ণান্ধ পূর্বপুরুষকাল হতে অদ্যাবধি
দু’মুঠ দুপুরে? বায়ুপরাগী যতো ফুল পার করছে
মুখরা ঋতুজরা, বর্ণান্ধ ইমপ্রেশনিস্ট আঁকছে
নারীকে, ক্ষয়ে যাচ্ছে তুলি, নিরাভরণ বেলনবাহু,
ফুরিয়ে যাচ্ছে রঙ রঙের ডালিতে। সপ্তাহান্তের
মেলানিনরেখা, কর্পোরেট কুটালাপরাশিরাহ্ণ,
মেরুবিন্দুর নীল ডানা দুটি মূলত একটা ছেলে
একটা মেয়ে, তাদের ক্ষীণায়ু স্তম্ভগুলি মিনিটের
জন্য জ্বলে উঠে নিভে যায়, একটা মুহূর্ত এমন
তোমার আমার নিরর্থক বসে থাকা হল শুধু।
ছাতিম
একটা পতিত সন্ধ্যায়
অর্শ- পাইলস- গেজ
সারানির টিন মারতেছে
কারা যেন ছাতিমের গায়
বিমর্ষ ছাতিম
তারে কেউ চেনে না পাতায়
চেনে না গীত- গোবিন্দে
চেনে কিনা মিথে
সৰ্পমোহন
যোনীগন্ধা
ইত্যাদি কিসসাকিসমিসে
আজ তারই উপসংহার
অধঃপতনের ষোলকলা
কী গন্ধ ঢাকবে আর,
কফিনই বা হইবে কী!
চলেন আধুনিক লিখি
তোমার আর্কিতে ক্রেটিনমাথার
মতো ঘুরে মরে স্পটলাইট,
সরলদোলক, গতিমিটারের
কাটা। ঠোঁটের দ্ব্যর্থক ডোপামিন,
আঙ্গুল ঠাসা নিকোটিন আর
ডায়েটে ভূপাতিত টেস্টোস্টেরন
নিয়ে- স্কাইলাইনসই খসে পড়ে
নক্ষত্রপুঙ্গব, নিউক স্যুইচে
কব্জি নাচায় স্যাজিটারিয়াস ও
কিউপিড। আমি ভুলে নাম তোলা
সোলজার, সেন্ট্রালে জেইলহাউজ
রক, আরোপিত ফোকভান।
পুরোনো প্রেমিকা
বিষন্নতার চেয়েও পুরানো ধ্বনিরা ঘোরে
পৃথিবীগর্ভের অতল ভেতর, সেখানে হীরকের
খনি বসে আছে ঠাঁয় আর জুবুথুবু, একান্ত
ব্যক্তিগত ফ্লোরার সাথেও বা কতটুকু চেনাপরিচয়!
বিহারের ক্ষয়ে আসা লাল লাল ইটের দেয়ালে
ফণিমনসা এলিয়ে দিয়েছে শরীর, শিশুর
অভিমানরূপে শ্রাবণের জলবৃত্ত তাতে মিশে যায়,
অন্ধ ঘোড়ার কী আসে যায় ঠুলি বা চশমায়!
লহমায় বিষণ্ণতা গুলে নীল হয় জল, প্ৰাঞ্জল
সমুদ্রে দেখি শিশু হাসে, জেগে ওঠে বালি,
জ্বলে ওঠে সূর্য ও চাঁদ, তারা ও জাহাজবাতি,
এসব আলোর ভেতরেই শিশুরা থাকুক, আর
অন্ধকার যতো পিতাদের হোক, তাদের ক্বলবে
থাকুক পুরানো প্রেমিকাদের নিরীহ যাতায়াত!
অষ্টগ্রাম
সে দূর অষ্টগ্রাম, পাকুরে তার বয়স থাকে
লেখা, শামুকে জলের, কাছিমে মাটির,
মানুষে নদীর- তার তলদেশে আমি পাকা
ডুবুরির চালে দেখে আসি পলিরেখা আর
স্থির জলের সমতলে যেখানে শালুক,
গোধূলির দিকে হেলে আছে সেখানে তুমি
মিছাই থাকো বসে, তোমার খনিতে অনেকে
যেমন বলে ওই দূর গ্রহের মতো জমে থাকে
জল, সেই জলে আমি শামুকের ক্যামোফ্লাজে,
কাছিমের শ্লথ পায়ে, মানুষের নিহিল হিংসায়
করে চলি স্ববংশবিস্তার, আমাদের দু’গলা
গান কলমিলতার বনে বর্ষায় ধুয়ে যায় প্রতিবার,
আমার ডুবুরি স্বভাব, সলিল তামাম দিন,
নির্বিষ সাপের দুঃখ পড়তে পারি, পারি গভীরতা
সুনিপুণ, খুঁজে দিতে পারি কাদায় হারানো
তোমার নূপুর, মাছের ফুলকার মতো পলকা
হাওয়ায় আমাদের মনে থাকে আমাদের ঘ্রাণ ৷