মারমা লোকগল্প ।। খোব্রোক
একদেশে ছিলো এক দরিদ্র লোক। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। অনেক চেষ্টা তদবির করে শেষে তার একটা বাচ্চা হয়। বাচ্চাটি মানুষের ছিলো না। বাচ্চাটি ছিলো একটা খোব্রোক। দরিদ্র লোকটি সেইসময় কাজ করতো রাজার বাড়ি। একদিন রাজা লোকটিকে ডেকে তার সারা বছরের পারিশ্রমিক দিতে চাইলেন। দরিদ্র লোকটি রাজার সামনে যেতে ভয় পেলো। সে পারিশ্রমিক আনতে খোব্রোককে পাঠালো রাজার বাড়ি। রাজা খোব্রোককে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন, “তুমি সামান্য এক খোব্রোক, তুমি কি করে বোঝা বইবে?” খোব্রোক বললো, “আমি পারবো রাজামশায়।”
খোব্রোকের কথা শুনে রাজার খুব রাগ হলো, তিনি রেগে গিয়ে বললেন, “সামান্য এক খোব্রোক, তুমি কয়টা হাড়ি বহন করতে পারবে, শুনি?” এবার খোব্রোক বললো, “আমার তো মানুষের মতো কাঁধ আর হাত নেই। তাই আমি হাড়ি কাঁধে করে নিতে পারবো না। আপনি দয়া করে আমার কানের মধ্যে ঢেলে দিন।” রাজা তো অবাক। খোব্রোক বলে কি? সত্যি সত্যি রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, “পাতো তোমার কান, দেখি কটা ধান তুমি নিতে পারো।”
এবার খোব্রোক কান পাতলো। রাজা তার পেয়েদাকে নির্দেশ দিলো, ঢালো খোব্রোকের কানে, দেখি কটা ধান ও নিতে পারে। কিছুক্ষণ পর রাজা অবাক হয়ে গেলেন। একে একে সে এক কানের মধ্যেই কি-না পঞ্চাশ হাড়ি ধান ঢুকিয়ে নিলো! এক কানে ধান নিয়ে, খোব্রোক আর এক কান পেতে দিয়েছে। রাজা ইজ্জতের দায় সেই কানেও পঞ্চাশ হাড়ি ধান ঢেলে দিলো। খোব্রোক পঞ্চাশ পঞ্চাশ করে দুই কানে একশ হাড়ি ধান নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। হেলেদুলে বাড়ির কাছে এসে জোরে জোরে মাকে ডাকতে লাগলো। ডেকে ডেকে মাকে বললো,
-মা, জলদি করে ফ্যায়া খুলে দেও। ধান শুকাতে হবে।
খোব্রোকের মা ছেলের ডাকে অস্থির হয়ে উঠলো। দূর থেকে দেখলো, অনেক কষ্টে ছেলে তার দুলে দুলে এগিয়ে আসছে। ছেলের কষ্ট দেখে মা তাড়াতাড়ি করে ফ্যায়া খুলে উঠানে বিছিয়ে দিলো। খোব্রোক এসে দুই কান থেকে ফ্যায়ার ওপর ধান ঢালতে লাগলো। যেন শেষই হয়। খোব্রোকের মা অবাক হয়ে গেলো ধান দেখে। সে বললো,
– এতো ধান? কি করে আনলি? কোথা থেকে আনলি?
খোব্রোক মিটমিট করে হেসে বললো,
– রাজবাড়ি থেকে।
খোব্রোকের বাবাও অত্যন্ত খুশি হলো তার ছেলের যোগ্যতা দেখে। এতোদিনের দুঃখ তার ঘুচে গেলো। এইভাবে দরিদ্র লোকটির অভাব মিটে গেলো। কিছুদিন পর লোকটি তার ছেলে খোব্রোকের জন্য মেয়ে দেখতে লাগলো। তখন খোব্রোকের মনে পড়লো রাজার অতি সুন্দরী কন্যার কথা। সে সাথে সাথে তার বাবাকে বললো,
বাবা রাজপ্রাসাদে যাও আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। রাজাকে গিয়ে বলো, রাজকন্যাকে আমার সাথে বিয়ে দিতে।
খোত্রোকের কথা শুনে তো তার গরীব বাবার হাঁটু কাঁপতে লাগলো। সে বললো,
– তুমি তো একটা ফা। রাজা কি রাজি হবে তোমার সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে?
খোব্রোক নাছোড়বান্দা। জোর করে বাবাকে পাঠিয়ে দিলো রাজপ্রাসাদে। রাজার সামনে গিয়ে হতদরিদ্র মূর্খ লোকটি হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে কাচুমাচু করতে লাগলো। রাজামশায় লোকটিকে অভয় দিলে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে শেষ পর্যন্ত বলে ফেললো,
– ক্ষমা করবেন রাজামশায়। বড় সংকট। বাবা হয়ে ছেলের আবদার ফেলতে পারলাম না। বলি, আমার ছেলের বিয়ের কথা বললেই সে, আপনার কন্যা, মানে রাজকন্যাকে বিয়ে করবে বলে দাবি করে বসলো।
রাজা সাথে সাথে ক্ষেপে গেলেন।
– কি? এতো বড় সাহস তোমার ছেলের, মানে সামান্য একটা খোব্রোক! তার এতো বড় সাহস, আমার কন্যাকে বিয়ে করতে চায়? আমি ওর গর্দান নেবো। তার আগে তোমার এবার ভয়ে লোকটার প্রাণ যায় যায়। তবুও তো কথা যখন উঠেছে। এক কথায় তো আর বিয়ে হয় না, ভাঙ্গেও না। ছেলে খোব্রোক বলে রাজাও তাকে ছোট করেছে। খুব আঁতে যা লাগলো তার। যায় যাক প্রাণ তবু অপমান মেনে নেওয়া যায় না। লোকটা সাহস নিয়ে ফেললো,
-আমার ছেলে খোব্রোক হতে পারে, তবে যোগ্যতায় কোন রাজকুমারের চেয়ে কম নয় রাজামশায়।
এবার রাজামশায়ের মনে পরলো, খোব্রোক তার দুইকানের মধ্যেই একশ হাড়ি ধান নিয়ে গেছে। তাকে তো আর এমনি এমনি নাকচ করে দেওয়া যায় না। আবার খোব্রোক বলে তাকে খুনও করা যায় না, তাতে রাজার মহত্ত্বই ছোট হয়ে যায়। কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে তিনি একটা কৌশল অবলম্বল করলেন, যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে। তিনি শেষে বললেন,
ঠিক আছে, আমি রাজি। তবে একটা শর্ত আছে। আমার শর্ত পূরণ করতে পারলে তবেই আমি রাজকন্যার সাথে তোমার ছেলে খোব্রোকের বিয়ে দেবো।
এবার দরিদ্র লোকটা যেন স্বস্তি ফিরে পেলেন। যাক বাবা, প্রাণ হারানোর ভয় তো গেছে! পূরণ করতে পারলে বিয়ে হবে, আর না পারলে বিয়ে হবে না। দেখাই যাক না, কি শর্ত দেয় রাজামশায়। কাচুমাচু করে বললেন,
যথা আজ্ঞা মহারাজ। বলুন আপনার কি শর্ত!
অনেক ভেবে চিন্তে রাজামশায় বললেন,
যাও, গিয়ে তোমার ছেলেকে বলবে, সে যদি এক রাত্রের মধ্যে আমার প্রাসাদের চারপাশে পুকুর খনন করে জল ভর্তি করে দিতে পারে তবেই আমি তার সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে দেবো। তবে অবশ্যই পুকুরের পানি হতে হবে স্বচ্ছ এবং সেই হল পানির পুকুর রঙিন রঙিন মাছ আর পদ্মফুলে ভরা থাকতে হবে, যেন দেখলেই মনে হয়। চিরকাল এই রাজপ্রাসাদ সেই পদ্মপুকুরে ঘেরা ছিলো। আর তা যদি না পারে তবে আমি তোমার আর ছেলের গর্দান কেটে নেবো।
এতো বড় মহাবিপদ। কোনকালে কে শুনেছে যে, একরাত্রে পুকুর কেটে তাতে জল ভরে? তার উপর আবার পদ্মফুলে ঢাকা! এ-তো অসম্ভব। গেলো বুঝি এবার ছেলের এখন বুঝি তারও মাথা কাটা যায়। চিন্তায় ভয়ে মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। বাড়ি ফিরে দুইদিন মুখে দানা পানি নিলো না। কোন কথাও বললো না। বউ অনেক পীড়াপীড়ি করেও কিছু জানতে পারলো না। অবশেষে খোব্রোক দেখলো, বাবার মুখ শুকিয়ে গেছে। নিশ্চয় রাজা বাবাকে কিছু বলেছে। ভেতরে ভেতরে খুব রাগ হলো খোব্রোকের। বাবাকে এক প্রকার জোর করেই বললো,
– বলো বাবা, তোমার কি হয়েছে? কি বলেছে রাজামশায়? তোমাকে অপমান করেছে? ছেলের পীড়াপীতিতে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলতে বাধ্য হলো তার বৃদ্ধ বাপ। বললো, রাজার দেওয়া শর্তের কথা। খোব্রোক রাজার দেওয়া শর্তের কথা শুনে স্থির হলো। কিছুক্ষণ ভেবে সে তার বাবাকে বললো,
তুমি রাজপ্রাসাদে যাও। গিয়ে রাজাকে বলো, আমি তার দেওয়া শর্তে রাজি আছি। আসছে পূর্ণিমার রাতে আমি তার প্রাসাদের চারপাশে পুকুর খনন করে দেবো। এবং সেদিনই আমাদের বিয়ে দিতে হবে। তবে আমারও একটা শর্ত আছে। শর্ত হলো, সেই পূর্ণিমার রাত্রে রাজপ্রাসাদ থেকে কেউ বাইরে বের হতে পারবে না। আর যদি কেউ বেরও হয়, তবে তার প্রাণ সংহার হবে।
বৃদ্ধ পুণরায় রাজপ্রাসাদে গেলেন। রাজাকে গিয়ে সব কথা খুলে বললেন। রাজাও খোব্রোকের মহিমা দেখার জন্য জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। এবার উভয়পক্ষের প্রস্তুতি চলতে লাগলো। পূর্ণিমার দিন যতো ঘনিয়ে আসে খোব্রোকের মা ততোই কাতর হয়ে পরতে লাগলো। রাতে শুয়ে ছেলেকে বোঝাতে লাগলো, “তুমি রাজার সাথে পারবে না বাবা। অকারণে তুমি প্রাণ দিতে যেও না।”
খোব্রোক মায়ের মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, “তুমি কোন চিন্তা করো না, আমি তোমার দোয়ায় সবকিছু জয় করতে পারবো।”
দিন যতো ঘনিয়ে আসে খোব্রোকের বাবা-মা’র দশা ততো করুণ হতে লাগলো, ওদিকে রাজামশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো, সামান্য এক ফা কি করে তার চ্যালেঞ্জ জয় করে। না হলে, এমন জব্দ করবে। মনে মনে সে পরিকল্পনা করতে লাগলো যোব্রোক হেরে যাবার পরদিন কি কি উপায়ে তাকে অপদস্থ করে প্রাণ কেড়ে নেওয়া হবে। সে ভাবতে লাগলো, প্রথমে খোব্রোকের চার পা বেঁধে ঠেলা গাড়িতে উঠিয়ে ওর ফোলা পেটের উপর রাজ্যের ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে উঠিয়ে দেওয়া হবে, যাতে ছেলে মেয়েরা লাফিয়ে লাফিয়ে মজা নিতে পারে আর ফোলা পেটের উপর শফলাফির যন্ত্রণায় খোব্রোকের দশা কেমন হয় তা দেখে রাজ্যের লোকেরা মজা নিত
থাকবে। এইসব ভেবে ভেবে রাজা অতি আনন্দে দিন গুনতে লাগলো।
অবশেষে সেই পূর্ণিমার দিন চলে এলো, সারাদিন খোব্রোকের মা খোত্রোকের পিছে ঘুরঘুর করতে লাগলো। সন্ধ্যায় পুব আকাশে যেই না থালার মতো বিশালাকার চন্দ্রের উদয় হলো, অমনি খোব্রোক মায়ের কাছে বিদায় নিতে। মা কন্নাকাটি করতে লাগলো। খোব্রোক তাকে শান্ত্বনা দিয়ে বললো,
-তুমি কোন চিন্তা করো না মা। আমি ঠিকই রাজকন্যাকে তোমার ঘরের বউ করে আনবো, এবার তুমি তোমার ছেলেকে দোয়া করে দাও।
খোঁব্রোকের মা, মোব্রোকের মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় করে দিলো। বাড়ি থেকে বেরিয়েই খোব্রোক সোজা চলে গেলো পশ্চিমদিকের এক উঁচু পাহাড়ের মাথায়। পাহাড়ে মাথায় ছিলো অনেককালের পুরনো এক মঠ। খোব্রোক লাফিয়ে লাফিয়ে মঠের ভিতরে ঢুকলো। মঠের ভেতরে তখন জোছনার আলো ঝলমল করছে। মঠের মেঝে থেকে একটু উপরে পাথরের বেদীর উপর রাখা ছিলো একটা কাঠের বাক্স। ধুলোবালিতে ঢাকা। পুরানো কারুকাজ করা বাক্স। বেদিতে উঠে ষোব্রোক চারপাশ ঘুরতে লাগলো। তারপর বাজে তিনটি টোকা দিতেই বাক্সটা খুলে গেলো। আর সাথে সাথে অসংখ্য জ্বীন-পরী বেরিয়ে এলো বাক্সের ভেতর থেকে। সারা মঠ ভরে গেলো জ্বীন-পরীতে। তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচতে লাগলো। উল্লাস করতে লাগলো। শেষে বেরিয়ে এলো রাজা রাণী। এসেই হাতজোড় দাঁড়ালো খোব্রোকের সামনে,
– যে মহান, যুগ যুগ পরে আপনি আমাদের মুক্ত করেছেন। আমরা আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। শত শত বছর আগে মঠের সাধুকে হত্যা করে এক শয়তান তান্ত্রিক আমাদের সবাইকে এই বাক্সের মধ্যে বন্দি করে রেখেছিলো। তারপর থেকে আমরা কখনো পূর্ণিমার আলো চোখে দেখিনি। আপনি আমাদের মুক্ত করেছেন, দয়া করে করুন আমরা আপনার কি উপকার করতে পারি!
খোব্রোক আশ্বস্ত করলো পরীদের রাজাকে। তারপর বললো,
– কিছুদিন আগে আমি বনে এসেছিলাম কাঠ নিতে। কাঠ কাটতে কাটতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সেদিন ছিলো এমনই এক পূর্ণিমার সন্ধ্যা। আমি দূর থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম কারা যেন চিৎকার করে কাঁদছে। তখন আমি এখানে এসে দেখলাম, এই মঠ। এবং মঠের ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। সেদিনই আমি আপনাদের মুক্ত করে দিতাম, কিন্তু আমি জানতাম না, কি করে এই বাক্সের ঢাকনা খুলতে হয়। অনেক খুঁজেখুঁজে একটা পুরনো নথি খুঁজে পেলাম এই পাথরের নিচে। ঐটা বাড়িতে নিয়ে খুলে দেখি, সেখানে লেখা আছে, যেকোন পূর্ণিমার রাতে কেউ যদি সাতবার এই বাক্সের চারপাশে ঘুরে তিনবার টোকা দেয় তবে খুলে যাবে বাক্সের ঢাকনা। আর সাথে সাথে মুক্ত হয়ে যাবে এক রাজ্যের জ্বীন-পরী আর তাদের রাজা-রাণী। যাই হোক, আজকের দিনের জন্য আমাকেও একমাস অপেক্ষা করতে হয়েছে, এই জন্য ক্ষমা করুন। খোব্রোকের বিনয় দেখে জ্বীন রাজা অতি প্রসন্ন আর লজ্জিত হলেন। তিনি মাথা নত করে বললেন,
-ছিঃ ছিঃ। এ আপনি কি বলছেন? আপনি আমাদের মুক্ত করেছেন এই জন্য আমরা সকলেই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনি যখনই ডাকবেন, যা বললেন তার জন্য আমরা সকলেই সদা প্রস্তুত থাকবো। দয়া করে বলুন আপনার জন্য আমরা কি করতে পারি।
এবার খোব্রোক মুখটা মলিন করে ঘুরে বসলেন,
-কি আর বলবো ভাই। সে-ও এক মহাদুঃখের কথা। রাজকন্যাকে পছন্দ করে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। আমি ফা বলে রাজামশায় আমার বাবাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলো।
খেব্রোকের দুঃখ দেখে জ্বীন রাজা কাতর হয়ে গেলো। সে বললো,
-আপনি দুঃখ করবেন না। আপনি যদি চান তো, এখনই আমি আমার সৈন্যদের পাঠিয়ে রাজকন্যাকে এখানেই তুলে আনতে পারি। রাজা টেরও পাবে না। খোব্রোক বাঁধা দিলো,
-না না, ভুলেও এ-কাজ করতে যাবেন না। রাজা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে তবে একটা শর্ত দিয়ে। আমি ফা হয়ে রাজার শর্ত কিভাবে পূরণ করি বলুন?
-মাত্র একটা শর্ত? হাজার শর্ত হলেও আমরা পূরণ করে দেবো। দয়া করে বলেন, কি সেই শর্ত।
খোব্রোক এবার জ্বীনরাজা’কে শর্তের কথা খুলে বললো। সব শুনে জ্বীনরাজা বললো,
-ওহ, এই কথা। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমার লোক দিয়ে আমি এক্ষুণিই রাজার দেওয়া শর্তমতে রাজপ্রাসাদের চারপাশে পুকুর বানিয়ে দিচ্ছি। আর আমার রাজ্যের যতো পরী আছে সকলে মিলে পৃথিবীর সবচে সুন্দর সুন্দর পদ্মফুল এনে সেই পুকুরে লাগিয়ে দেবে। সকালে উঠেই রাজা যেন পুকুরের সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। যেই কথা সেই কাজ। সাথে সাথে জ্বীনরাজা সকল জ্বীন আর পরীদের ডেকে কার কি কাজ সব বুঝিয়ে দিলো। মুহূর্তের মধ্যে, মঠ খালি করে সমস্ত দ্বীন-পরী উড়ে গেলো। জ্বীনরাজা আর রাণী মিলে খোব্রোকের দুই ঠ্যাঙ ধরে উড়িয়ে নিয়ে চললো রাজপ্রাসাদের দিকে। খোব্রোককে নিয়ে রাজপ্রাসাদের চারপাশে জ্বীনপরীদের কাজ করা দেখতে লাগলো। মধ্যরাত পাড় করে ভোর হবার আগেই পুকুর কাটা শেষ হয়ে গেলো। পরীরা কোথা থেকে ফুটন্ত পদ্মফুলসহ লতা এনে রোপন করতে লাগলো। চারপাশ সাজানোর পর মুহূর্তেই জলে ভরে গেলো সেইসব পুকুর। পরীরা সেই পানিতে নেমে গোসল করতে লাগলো। জোছনার শেষ প্রহরে রাজ্যের সকল দ্বীন-পরী মুক্তির আনন্দে পানি ছিটিয়ে আনন্দ করছে দেখে তাদের রাজাও খুব খুশি হলো। এবার আরও একটা জিনিস বাকি। সেটা হলো মাছ। খোব্রোক জ্বীনরাজাকে বললো,
– সব আছে, শুধু মাছ নাই।
খোব্রোকের কথা শেষ হতে না হতেই একদল জ্বীন ছুটে গেলো মাছের সন্ধানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে দামী নামী রঙ-বেরঙের মাছ এনে ছেড়ে দিলো পুকুরের পানিতে। ষোরোক জ্বীনদের প্রতি খুব খুশি হলো। রাত শেষ প্রহর। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আলো ফুটবে। এবার জ্বীনরাজা খোব্রোককে বললো,
-রাত প্রায় শেষ। আমাদের আর থাকার উপায় নেই। দয়া করে অনুমতি দিন, আমরা আমাদের রাজ্যে ফিরে যাই। খোত্রোক সহাস্যে জ্বীনরাজাকে বিদায় দিলো। জ্বীন রাজা যাবার সময় একটা মিহি কাপড়ের সুগন্ধিযুক্ত একটা রুমাল দিয়ে বললো,
– যদি কখনো দরকার পরে, তবে পাহাড়ের উপর সেই মঠের সামনে গিয়ে এই রুমাল ঝাড়া দিলেই আমার সৈন্যরা এসে হাজির হবে। আপনি তাদের কাছে আপনার প্রয়োজনের কথা বলে দিলেই আমি আপনার সেবায় নিয়োজিত হবো।
এই বলে সমস্ত দ্বীন-পরীদের ডেকে নিয়ে জ্বীনরাজা আর রাণী উড়ে গেলো আকাশের দিকে। খোব্রোক রাজপ্রাসাদের ফটকের সামনে বসে রইলো। এদিকে একমাত্র ছেলের কিনা কি বিপদ হয় এই চিন্তায় সারারাত ঘুমাতে পারলো না তার বৃদ্ধ বাবা-মা। আলো ফোটার আগেই তারা রাজপ্রাসাদের সামনে এসে হাজির হলো। শর্ত অনুযায়ী তখনো রাজপ্রাসাদের কেউ বাইরে আসেনি। খোব্রোকের বাবা-মা এসে দেখলো, একি মহাকাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছে তার ছেলে। এমন ছেলে পেটে ধরার জন্য খোব্রোকের মায়ের বুক চওড়া হয়ে গেলো। খোব্রোকের বাবার সাহস বেড়ে গেলো অনেকগুণ। এবার রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকের সামনে বসে আলো ফোটার অপেক্ষা করতে লাগলো তিনজনে। বারবার পুব আকাশে তাকাতে লাগলো। অপেক্ষার মুহূর্ত অতি দীর্ঘ হয়। মাত্র কয়েক মিনিট যেন কয়েক বছর মনে হলো তাদের কাছে। শেষে লাল আভা দেখে পুলকিত হয়ে উঠলো তারা। এবার গা ঝাড়া দিয়ে গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো খোব্রোক, আর তার মা-বাবা। কড়কড় আওয়াজ করে প্রাসাদের প্রধান দরজা খুলে গেলো। বেড়িয়ে এসেই হুঙ্কার ছাড়লো রাজা,
-কই সে ফায়ের বাচ্চা? এতো বড় সাহস, আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। আজ এর চামড়া দিয়ে ঢোল বানাবো।
রাজার হুঙ্কারে খোত্রোকের বাবা ভয় পেয়ে গেলেও খোব্রোকের মা কোমড়ে আঁচল প্যাচ দিয়ে রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো খোব্রোক। খোব্রোকের মা বলল,
– তার আগে নিজের দেওয়া শর্তের কথা স্মরণ করুন রাজামশায়। নিজের দেওয়া কথা। নিশ্চয়ই আপনি অবমাননা করতে পারবেন না। রাজার খুব রাগ হলেও কিছু বলার নেই। কারণ সে নিজেই এই এবার সে থেকে প্রাসাদ প্রদক্ষিণ করতে বের হলো। একি সর্বনাশ! এ করে সম্ভব! হায়! হায়! ফটক ছেড়ে যতো যেতে লাগলো ততোই মুখ লাগল রাজা তো সব না। কি সুন্দর পুকুর আর কি তলদেশের প্রতিটি শ্বেত বালু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সারা পুকুর জুড়ে মাপেমাপে ফুটে আছে পদ্ম। নীল পদ্ম, শ্বেত পদ্ম, রকাত, আরও কত রকমের পদ্ম। তাতে খেলা করছে রঙ-বেরঙের মাছ। যে মাছ রাজা এর আগে কখনো দেখেনি। পুরো প্রাসাদের চারপাশ ঘুরে আসতে রাজা সারাদিন কাটিয়ে দিলো। সারাদিন খোত্রোক আর তার বাবা-মা। গেটের সামনে বসে রাজার অপেক্ষা করতে লাগলো। সন্ধ্যায় যখন রাজা গেটের কাছে ফিরে এলো তখন রাজার চোখ-মুখ চকচক করছে। কিন্তু মন ভারাক্রান্ত, তাই বলে একটা ফায়ের সাথে মেয়ের বিয়ে। এবার খোব্রোক রাজার সামনে এসে দাড়ালো।
-ক্ষমা করবেন রাজামশায়, রুপ আর সৌন্দর্য দিয়ে যারা যোগ্যতা বিচার করে তাদের মতো বোকা পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আমি আমার যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছি, এবার সিদ্ধান্ত আপনার।
এই বলে খোরোক মা-বাবাকে ডেকে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালো। রাজার কানে তখন বারবার বাজতে লাগলো, “রুপ আর সৌন্দর্য নিয়ে যারা যোগ্যতা বিচার করে তাদের মতো বোঝা পৃথিবীতে আর কেউ নেই।” সত্যি তো, খোব্রোক খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে। রাজা নিজের বোকামি বুঝতে পারলো। সাথে সাথে লোক পাঠালো খোব্রোককে ধরে আনার জন্য। এবার আর পাকড়াও নয়, অতিশয় আসরে তাকে ধরে আনতে বলে, গেটে ফুলেল শুভেচ্ছার ডালি সাজাতে লাগলো। নানারকম আলোতে ঝলমল করে উঠলো রাজপ্রাসাদ। এমন যোগ্য ছেলেই তো আসলে রাজকন্যার উপযুক্ত। রাজা যেন মুহূর্তের মধ্যে নিজের মন থেকে সমস্ত ক্লেশ ছুড়ে ফেলে দিলো। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সেই রাত্রেই খোব্রোকের সাথে তার সুন্দরী কন্যাকে বিয়ে দিয়ে দিলো। তারপর সাতদিন ধরে রাজ্যের সমস্ত লোকদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হলো। লোকেরা খোব্রোকের যোগ্যতা আর রাজার উদারতা দেখে ধন্য ধন্য করে বাড়ি ফিরলো। রাজকন্যাকে বিয়ে নিয়ে রাজা খোব্রোকের নামে রাজ্যের অর্ধেক লিখে দিলেন। সেখানে তৈরি করে দিলেন বিশাল প্রাসাদ। খোব্রোক তার মা-বাবা আর বউকে নিয়ে সুখে সংসার করতে লাগলেন।
টীকাঃ
খোব্রোক – কুনোব্যাঙ ।। ফ্যায়া – বাঁশের তৈরি চাটাই ।। ফা – ব্যাঙ
সংগ্রাহক – অং মারমা