কবিতা 

মিজানুর রহমান রুবেলের কবিতা

মুহূর্ত

রসুইঘরে,
হঠাৎ দুধের পেয়ালা অসাবধানে উল্টে গেলে
তুমি তুলে আনো-
শিমুল কাঁটার ছায়ায় নতমুখে দাড়িয়ে থাকা
অন্ধকারে আমার একলা অতীত,
আমার আজন্ম কৃতঘ্ন স্মৃতি-
কেবল আমার মায়ের শ্বেত স্তনযুগল।
পিতার দেয়া রূপোর পুরোনো বালা জোড়া
হাতে নিয়ে
যে মা অবহেলায় একা একা গিয়েছে মরে
আমার এক প্রাচুর্যের সকালে।।

তোমারে মনে রাখি আমি

ডানায়
দুরন্ত জীবনের অন্ধ ভায়োলিন বাজিয়ে
মূহুর্তের ব্যবধানে
তুমি উড়তে উড়তে মেঘের সীমানা পেরিয়ে গিয়েছো
অবলীলায়;
চেনা দিগন্তের সরল জ্যামিতি
তুমি চীড়ে দিয়েছো সহস্রবার- ধারালো নখের আঘাতে।
অথচ, দেখো-
কালো মেঘের মতন আদিম এক ব্যামোর অভিশাপে
একদিন
তুমি উড়বার আজন্ম অহমিকা পেছনে ফেলে,
নেমে আসো ধীরে
আরো ধীরে-
জড় বাদামী মাটিতে।

ডানার তারুন্য ক্ষয়ে গেলে লোকালয়ের আড়ালে
মৃত্যুর হিম অভ্যর্থনায় তুমি কাতরাতে থাকো,
কাতরে যাও
কাতরে যাও
তুমি একা,
কেবলই একা
যেন নিঃসঙ্গ এক ভীষণ ক্লান্ত ছায়া।

তোমার জন্য আমার মায়া হয়, চিল।
তোমার না থাকা ডানার তরঙ্গ
আজো শোকের বিউগল হয়ে বাজে ,
যখন
একটা বিকেল খেয়ে ওঠা সন্ধ্যা নেমে আসে পৃথিবীতে।
এত মৃত্যুর ভীড়েও তোমার নাম আমি মনে রাখি-
ওগো ধুসর রঙের একলা চিল;
বাতাসের পালে তোমার গন্ধ শুঁকে শুঁকে
আজো আমি বলে দিতে পারি-
তুমি ছিলে এইখানে,
এই অরন্য এই লোকালয়ের পাঁজরের উপড়
ঝুলে থাকা আকাশে- নিজের জন্মের স্মৃতি আর
হা করে থাকা মৃত্যুর মুখ ভুলে গিয়ে,
তুমি ছিলে এইখানে-
মরতে থাকা অজস্র করুন সব জীবনের ভীড়ে।

জন্মদাগ

তোমার স্মৃতি পেরিয়ে যেতে আমি
ভ্রমন করি নিকোটিনের সাকো,
মদের পেয়ালায়
আমি বিনা দ্বিধায় একে দেই খৈয়াম,
সাথে হাফিজের শরাব সুরার সাকি।

তবু
আমি তোমাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারি না,
অবিশ্বাসের ক্যামোফ্লেজে নিজের হৃদয় লুকিয়ে রেখে
উচ্চারণ করতে পারি না- আমি কখনো জন্মাইনি।

তোমার চুলের ঘ্রান আমার
পাঁজরের তলদেশ হতে মুছে ফেলতে
রোজ রাতে আমি ক্রীতদাসের বেশে
চলে যাই,
সুগন্ধী বিক্রেতা এক কাফেলার সাথে-
সুদূর পারস্যের এক বেনামী নগরে।

তবু তোমার ঘ্রাণ, তোমার স্মৃতির
সবটুকু স্বর
জন্মদাগের মত আমার কপালে
লেখা থাকে জীবনভর।।

প্রেম

তোমার খুব করে কাছে গেলে,
শিউলি ফুলের ধবধবে সাদা জমিন ছেড়ে
অভিমানে সমস্ত কমলা রঙ
কেমন আলগোছে খসে পড়ে!
তবে কি দূরত্বে প্রেম থাকে?
শুনেছি-
দূরের নক্ষত্র ভীষণ কাছে এলে
মাটির পৃথিবী তাতে কেবলি পোড়ে!

পশ্চিম শেওড়াপাড়া

আমি হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম,
এইসব সরু সরু রাস্তা দিয়া আমি কখনো আসি নাই
শহরের এই দিকটায়।
আমি আসি নাই তবুও এই পুরান পুরান ঘরগুলি
এই বিল্ডিংগুলি ঠিকই দাঁড়ায়া ছিল।
আমি দেখি নাই তবুও এদের গা বেয়ে বেয়ে
উপরে উইঠা গেছে লতা টাইপের ফুল গাছ।
কাগজের মত পাপড়ি ফোটাইতে থাকে যারা
সকাল- বিকাল- সন্ধ্যা।
বেগুনি রঙের কত কত ঝরা ফুল প্রতিদিন পইড়া থাকে
গেটের সামনে
আধা মাটি আধা কংক্রিটের ছোট্ট বাগানে।

কত কাছেই আমার জন্ম!
অথচ আমার কখনও আসা হয় নাই এই দিকটায়।
এইখানে সবসময়
বিকাল খেয়ে ওঠা একটা সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব
নেশাগ্রস্তের মত ঘুমায়া থাকে;
যেন ঠিক ঢাকা শহর হইয়া উঠতাছে না এরা,
যেন সেই পঁচানব্বই সালের বেবিট্যাক্সির হলুদ ঢাকা,
যেন ঢাকার মফস্বল,ঢাকার গ্রাম হইয়া
আধো ঘুমে জাইগা আছে এরা।

মনে হয়, এইসব বাসাগুলায় কথা অত বলে না লোকে,
গল্প অত করে না লোকে;
তবে চিনি কম দিয়া চা খাইতে দেয় হঠাৎ অতিথি এলে।
তাদের বাসায় ঢুইকা আচমকা আলাপ করতে ইচ্ছা হয়!
ইচ্ছা হয়, জিজ্ঞাস করি,আজকে খাইছেন কি- দুপুরে?
টানা বারান্দায় যে বেতের পুরান দোলনা ঝুলতাছে
সেইটাতে বইসা
মৃদু দুলতে দুলতে এরা বলবে- আমরা ছোটমাছ খাই কম তেল দিয়া,
মাংস তেমন একটা খাই না আমরা।

ঢাকায় অনেক দিন গেলো কুয়াশা দেখি না।
এখানে শীতের সকালে এখনও দল বাইন্ধা কুয়াশারা পড়ে।
এরা ঘরের বাইরে যায় না তেমন একটা ।
কারন মৃত্যু খুঁজতে বাইরে যাইতে হয় না,
মৃত্যু এদের ঘরেই মইরা পইড়া থাকে।
তাই
এইখানে আমি থাকতে চাই,
এই পশ্চিম শেওড়াপাড়ায়।
এইখানে সহসাই প্রেম হইয়া উঠতে পারে
কালো ফ্রেমের চশমা পড়া মেয়ের সাথে অল্প-স্বল্প কথায়।

এইখানে কোন কিছুরে না পাত্তা দেওয়া
কেমন একটা নির্লিপ্ততা
পোষা বিড়ালের মতন মানুষের সাথে উঠে-বসে।
কোন ঘটনাই যেন ঘটনা না,
কোন আলাপই যেন আলাপ না।
জন্ম-মৃত্যু দুপুরের মত নীরবে আসে যায়
তাই
আমি থাকতে চাই শেওড়াপাড়ায়,
এইখানে এই কাগজের মত বেগুনী রঙের পাপড়ি
আর কুয়াশা দেখতে দেখতে মরতে চাই
এই পশ্চিম শেওড়াপাড়ায়।

 

মোনালিসা

আমার এক সোনালী বিকেল
চিবুকে জড়িয়ে ধরে তুমি বলেছিলে-
আমার চোখের মত এমন উন্মাদ বসন্ত
এ জীবনে দেখোনি তুমি!
শুনে-
আমি সমস্ত রাত শিশিরের মত গলে গলে পড়েছি
তোমার প্রেম-প্রলাপে।

এই বিষাদ শহরের ভীষন ক্লান্তি
আর
নিত্য পাওয়া অপমানের হিসেব উপেক্ষা করে,
তোমার ঠোঁটের কিনারা ঘেঁষে
আমি বুদ হয়ে রোজ বসে থেকেছি
এক পৌনঃপুনিক উষ্ণতার আশায়।

কিভাবে পারো তুমি মেয়ে
এমন করে জানতে আমায়!!

দায়মুক্তি

অস্তগামী সূর্যের দিকে পৃথিবীকে দাঁড় করিয়ে
আমি তোমার দিকে নত হই, প্রিয়তমা।
তোমার তাচ্ছিল্যের পেয়ালায়
স্বেচ্ছায় চুমুক দিয়ে
অবহেলার আধারে আমি বেঁচে থাকি না,
ডুবতে থাকা আতিকায় নক্ষত্রের মতন
আমি এক অন্ধ কবি হয়ে মরে যাই।

আমার আরও একবার জন্ম হয়,
অস্তগামী সূর্যের দিকে পৃথিবীকে দাঁড় করিয়ে
আমি তোমারই দিকে রুকু করি ফের।
তোমার তাচ্ছিল্যের পেয়ালায়
পুনরায় চুমুক দেই, প্রিয়তমা।
তোমার অবহেলার আনন্দে আমি বেঁচে থাকি না,
শীতের সকালে সোনালী রোদের চিতায় পুড়ে
খাক হয়ে যাওয়া কুয়াশার মতন
আমি এক অন্ধ কবি হয়ে মরে যাই।

আমার আরও আরও একবার জন্ম হয়,
আমি এক বেনামি নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকি চিরকাল।

প্রিয়তমা!
দেখে নিয়ো-
তোমার সমস্ত তাচ্ছিল্যের ঋণ
তোমারি পথে নক্ষত্রের আলো জ্বেলে
আমি ফিরিয়ে দিব একদিন!!

অস্তিত্ব চাই না

তোমার স্মৃতি-
ভোরের আলো হয়ে আমার পেছনে দৌড়ায়।
কী দীর্ঘ এক একটি ভোর।
লুকাবো বলে আমি গাঢ় অন্ধকার খুঁজে বেড়াই।
খুঁজতে খুঁজতে আমি ফিরে যাই
সেই আদি অন্ধকারে- মাতৃগর্ভে।

তোমার স্মৃতি-
আমায় মাতৃগর্ভের পথ চেনায়,
যেন এক না জন্মানো প্রেমিক আমি।

রহমত

ইব্রাহিমের মাবুদের দুনিয়ায় আজ
বৃষ্টি হোক অবিরত;
সমস্ত বৃক্ষের দল ডুবে যাক গলা অবধি
উত্তর-দক্ষিণ-পুব-পশ্চিম সারি সারি।

আমি আমরা তুমি তোমরা
নির্বাহী আদেশে
হয়ে উঠবো শীতল রক্তের জলজ প্রাণি।
জন্ম আর মৃত্যুর রঙেই কেবল অভিন্ন নয় জলজেরা,
বরং সকলেই কেবল তৃণ আহারে মনোযোগী।
এমনকি খুনে শোল-বোয়ালেরাও তৃণেই সীমাবদ্ধ।

বৃষ্টির শেষে মাবুদের হুলিয়া নিয়ে
হাজির হবে
কেতাবের সেই আসমানি ধীবর,
তারপর
সকল জলজেরা বৃক্ষের শিরে
নত আখেরি হিসাবে ;
আমলনামার অক্ষর যত, পূণ্যের পরিমাণ তত!
মাবুদের বৃষ্টির জলে
পাপের অবগাহন হয় পূণ্যে।।

Related posts