আলাপচারিতা বাদ-প্রতিবাদ বিশ্বসাহিত্য 

ওসমান সেমবেনের সাথে বনি গ্রিয়ারের আলাপ ।।ভাষান্তর-জয়ন্ত বিশ্বাস

ওসমান সেমবেন (১৯২৩-২০০৭)

আমাদের কাছে আফ্রিকার পরিচয় ‘অন্ধকার মহাদেশ’ নামে। বিশ্বায়নের এই যুগে এসে আসলে এই পরিচয় খুব একপেশে, সরলরৈখিক মনে হয়। নিজস্ব সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-সভ্যতার এক লালনভূমি হিসাবে আফ্রিকা এখন নিজ পরিচয়েই আলোকিত। আর পৃথিবীব্যাপী এই আলোটিকে সেলুলয়েডে জড়িয়ে ছড়িয়ে দেওয়া মানুষটির নাম ওসমান সেমবেন (Ousmane Sembene)। তাঁকে সারা দুনিয়ার মানুষ চেনে ‘আফ্রিকান চলচ্চিত্রের জনক’ নামে। কথাটা শুধু অক্ষরিকভাবে নয়, মর্মে মর্মে সত্যি। একই সাথে লাস্যময়ী ও রহস্যময়ী এই আফ্রিকার নিজস্ব জীবনদর্শন অদ্যবধি রূপালী পর্দায় তাঁর মত সুচারুভাবে কেউই তুলে আনতে পারেন নি।

সেমবেন জন্ম নেন ১৯২৩ সালে; সেনেগাল এর কাসাম্যান্স (Casamance) প্রদেশের জিগুইনচোর (Ziguinchor) গ্রামে। তাঁর জন্ম লিবৌ (Lebou) নামক এক জেলেগোত্রে।

বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁর পূর্বপুরুষের ধর্ম ছিলো সেরের (Serer) । তুর (Turr) নামক ধর্মীয় উৎসবে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে পানীয় পরিবেশনের কাজে তাঁকে নিয়োজিত করা হয়। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ সময় ওই পানীয় তিনি নিজেই পান করে ফেলতেন।

মাতৃভাষা ওলোফ (Wolof) এর পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ আর আরবি জ্ঞানও তাঁর ছিলো। রাজধানী ডাকার-এ গিয়ে তিনি দিনমজুরির পেশায় যুক্ত হন। তৎকালীন সময়ে সেনেগাল ছিলো ফ্রান্সের উপনিবেশ। তিনি পরবর্তীতে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীতে (Tirailleiurs), যোগ দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এরপরে ফ্রান্সে এসে মার্সেই শহরে বন্দর শ্রমিকের কাজ নেন। কিন্তু যাঁর রক্তে প্রবাহিত হচ্ছিলো সাহিত্যের প্রতি তীব্র অনুরাগ, এসব কাজে তাঁর মন যে বসবে না -এটাই স্বাভাবিক।

ফ্রান্সেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এর মাধ্যমেই তিনি হারলেম রেনেসাঁর লেখক ক্লদ ম্যাকে (Claude McKay) এবং হাইতিয়ান-মেক্সিকান লেখক জাঁ রোমি (Jacques Roumain) প্রমুখের লেখার সাথে পরিচিত হন। নিজের জীবনের ছায়া নিয়েই সেমবেন রচনা করেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘Le Docker Noir’ (The Black Docker, 1956)। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘O Pays, mon beau peuple!’ (Oh country, my beautiful people!, 1957)-এ তিনি সেটিং হিসাবে বেছে নেন নিজের জন্মভূমি ‘ক্যাসাম্যান্স’-কে।
তাঁর তৃতীয় ও সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘Les Bouts de Bois de Dieu’ (God’s Bits of Wood, 1960)। অনেকে এটিকে এমিল জোলা (Émile Zola)-র ‘Germinal’ উপন্যাসের তুলনা দেন।
সবশেষে তাঁর সাহিত্যসংকলন Voltaïque (Tribal Scars) প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ‘Harmattan (The Harmattan) এই সংকলনের “La Noire de…” এরই চিত্ররূপ।

১৯৬২ থেকে ১৯৬৩, পুরো এই একটি বছর সেমবেন মস্কোতে কাটান। এসময়ে তিনি মার্ক দনস্কয় (Mark Donskoy)-এর তত্ত্বাবধায়নে ‘গোর্কি ফিল্ম স্টুডিও’-তে ফিল্মমেকিং-এর উপরে পড়াশুনা করেন। এরপর থেকেই তাঁর সাহিত্যকর্ম গুলো ভিন্নধর্মী হতে শুরু করে।

১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ‘Le mandat, précédé de Vehi-Ciosane’ (The Money Order and White Genesis) উপন্যাসে সেমবেন উপনিবেশিকতাবাদ ও আর্থসামাজিক বৈষম্য-কে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘Xala’ (Impotence)-তেও আফ্রিকার পাপাচারে নিমজ্জিত উচ্চবর্ণীয়দের দিকে আঙ্গুল তোলা হয়েছে। তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস ‘Le Dernier de l’empire’ (The Last of the Empire, 1981)-এ সদ্যস্বাধীনতা প্রাপ্ত একটি দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের গল্প বলা হয়েছে। ‘Les Bouts de Bois de Dieu’ এবং ‘Xala’-র মত শক্তিশালী লেখাগুলো ওলে সোয়িঙ্কা (Wole Soyinka)-র মত সেমবেন-কেও আফ্রিকার প্রথম সারির একজন পোস্ট-কলোনিয়াল লেখকের মর্যাদা এনে দেয়।

সেমবেন-এর চলচ্চিত্র নির্মাণের পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিলো আফ্রিকার বাইরেও পৃথিবীব্যাপী মানুষের কাছে তাঁর কন্ঠ, তাঁর চিন্তা পৌঁছে দেওয়া। ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে তাঁর দুইটি শর্টফিল্ম ‘Barom Sarret’ (The Wagoner) ও ‘Niaye’ মুক্তি পায়। সাব-সাহারান আফ্রিকার প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘La Noire de…'(১৯৬৬) তাঁরই ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়। ফ্রেঞ্চ ভাষায় নির্মিত ৬০ মিনিটের চলচ্চিত্রটি Prix Jean Vigo পুরস্কার জেতে; এর সাথে তিনিও পরিচিতি পান।
১৯৬৮ সালে সেমবেন-এর লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়। তিনি নিজের মাতৃভাষা ওলোফ ভাষায় নির্মাণ করেন ‘Mandabi’ চলচ্চিত্রটি।

এর পরে নির্মিত Xala (1975, ), Ceddo (1977), Camp de Thiaroye (1987), and Guelwaar (1992), প্রতিটি চলচ্চিত্রই আফ্রিকার জন্য একেকটি মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত। তবে তাঁর চলচ্চিত্ৰগুলো বোদ্ধামহলে সমাদৃত হলেও বিভিন্ন জায়গাতে নিষিদ্ধও হয়। প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রই আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। তাঁর একেকটি চলচ্চিত্র আফ্রিকা মহাদেশের একেকটি জীবন্ত ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেলুলয়েডে তিনি পৃথিবীর সামনে ‘সত্যিকারের আফ্রিকা’ তুলে এনেছেন।
সেমবেন নিজেও ২৭ তম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারকের দায়িত্ব পান। ১৯৭৯ সালে ১১শ মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁকে সম্মানসূচক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

২০০৪ সালে তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘Moolade’ নির্মিত হয়। এটি সম্পূর্ন চিত্রায়ন বারকিনা ফাসো-র একটি ছোট গ্রামে করা হয়। এর বিষয় ছিলো অত্যন্ত বিতর্কিত- নারীর লিঙ্গ কর্তন (female genital mutilation)। নির্মাণের পর থেকেই এটি নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। তবে শিল্পের বিচারে এটি পরিচিতি ঠিকই পায়। ২০০৪ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মুলাদে’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে স্বর্ণপাম লাভ করে।

সেমবেন-এর চলচ্চিত্র জাতপাত নির্বিশেষে মানুষের কথা বলে। একদিকে যেমন এগুলোতে ঔপনিবেশিকতা ও ধর্মীয় নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা রয়েছে, তেমনি আফ্রিকার বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথাও রয়েছে। এতে যেমন আফ্রিকার নিজস্ব ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে তুলে আনা হয়েছে, তেমনি আফ্রিকান নারীদের নিজস্ব শক্তিকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। সর্বোপরি সেমবেন-এর চলচ্চিত্র একটি বিষয়ে আপোষহীন। সেটি হচ্ছে সত্যের পক্ষে ও মিথ্যার বিপক্ষে অনড় অবস্থান।

সেমবেন নিজেও তাঁর চলচ্চিত্রগুলোতে চরিত্র রূপায়ন করেছেন, অর্থাৎ ক্যামিও রোল করেছেন। যেমন ‘Mandabi’-তে রূপালী পর্দায়
তাঁকে দেখা গিয়েছে পোস্ট অফিসে চিঠি-লেখক হিসেবে।

আফ্রিকার এই ক্ষণজন্মা পুরুষ, ‘আফ্রিকান চলচ্চিত্রের জনক’ ওসমান সেমবেন ২০০৭ সালে ডাকার-এ মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৫ সালে তাঁর জীবন নিয়ে ডকুমেন্টারি ফিল্ম
‘Sembene!’ নির্মিত হয়।

শুরু করার আগেই একটি কথা উল্লেখ করে নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছি। যে ভদ্রলোকের সাক্ষাৎকার এখন নেওয়া হবে, আমি নিজেই তাঁর একজন বড় মাপের ভক্ত। এ কারণেই এই মুহুর্তে আমি অনেকটা নার্ভাস বোধ করছি। তবে আমি চেষ্টা করব আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চটাই দেওয়ার। তাছাড়া, অনুবাদক হিসেবে উপস্থিত আছেন মিঃ সেমবেনের জীবনীকার মিঃ সামবা গাডজিগো (Samba Gadjigo) , যার আরেকটি পরিচয় হচ্ছে- তিনি মাউন্ট হোলিওক কলেজ, ম্যাসাচুসেটস (Mount Holyoke College, Massachusetts)-এর ফরাসি ভাষার নামজাদা অধ্যাপক। 

ব. গ্রি. : এমন একটি ট্রিলজির দ্বিতীয় চলচ্চিত্র হিসাবে আপনার ‘মূলাদে'(Moolaade) জনসমক্ষে আসে, যেটিকে আপনি উল্লেখ করেছেন ‘দৈনন্দিন জীবনের বীরত্বগাঁথা’ নামে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাবেন কি ? 

ও. সে.: প্রথমেই যে বিষয়টা পরিষ্কারভাবে বুঝে নেওয়া দরকার, সেটা হচ্ছে- আমরা কথা বলছি আফ্রিকা মহাদেশ নিয়ে। বিভিন্ন রকম সমস্যায় জর্জরিত একটি মহাদেশ। এই মহাদেশের অভ্যন্তরে যে অসংখ্য যুদ্ধবিগ্রহ চলছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় কারও নেই। এখানে মহামারী আর দুর্যোগ আসে পাল্লা দিয়ে। কিন্তু অন্যদিকে, এই মহাদেশে নারী পুরুষ নির্বিশেষে এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা নিয়মিতভাবেই বীরত্বের সাথে বহুমুখী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের এই সংগ্রামের পিছনে ক্ষমতা আত্মসাতের কোন পরিকল্পনা নেই। আমি বিশ্বাস করি, এঁদের এই সংগ্রামী মনোভাবই আমাদের গোটা সমাজের মূল চালিকাশক্তি। তাঁদের সংগ্রামের উপরে ভর করেই এই সম্পূর্ণ মহাদেশ দাঁড়িয়ে আছে। আমি আমার নিজের জায়গা থেকে তাঁদের এই সংগ্রামের প্রতি সাধুবাদ জানাতে চেয়েছি। কারন, তাঁদের এই নীরব সংগ্রামের আমিও একজন সাক্ষী।
যে ধাঁচের সমাজ থেকে আমি এসেছি, সেখানে ভাল করে তাকালেই গল্পবলিয়েদের একটা আলাদা ধারা আপনার চোখে পড়বে। সেটা মান্দিংকা* (Mandinka), বাম্বারা* (Bambara) অথবা ফুলানি* (Fulani) –যে কেউ হতে পারে। দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাগুলো স্মরণে রাখাই ছিল তাঁদের মূল কাজ। রাতে তাদেরকে ঘিরে মানুষ বসে জমে যেত আর তারা সেই স্মৃতিতে সযত্নে আগলে রাখা গল্পগুলো শোনাত। আমি নিজেকে সেই গল্পবলিয়েদের এক সমান্তরালে প্রতিদিন খুঁজে পাই। সেই ঐতিহ্যবাহী সমাজে গল্পবলিয়েরা একাধারে লেখক, পরিচালক, অভিনেতা আর গীতিকার- সব কয়টি ভূমিকাই পালন করত। আমার মনে হয়, সমাজকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলার পিছনে তাঁদের অবদান প্রচুর। বর্তমানে আমরা আধুনিক প্রযুক্তি আর যন্ত্রগত কৌশল দুইই রপ্ত করেছি। এখন তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমাদের অনেক কিছু করার আছে।
ব. গ্রি. : আপনি বলেছেন যে ‘মূলাদে’-ই আপনার করা সবচাইতে ‘আফ্রিকান’ঘরানার চলচ্চিত্র। এটি ব্যাখ্যা করবেন কি ?
ও. সে. : যখন আমি এই বক্তব্য দিয়েছিলাম, তখন আমি এটার বাচনিক কাঠামোবিন্যাস ও নন্দনতাত্ত্বিকতা- এই দুইটি দিক বুঝাতে চেয়েছিলাম। তবে শেষপর্যন্ত এই বিচার মানুষের হাতেই যায়, আসলেই তাঁদের বাস্তবতার কিছুটা হলেও কাছাকাছি আমি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি কিনা। ইতোমধ্যেই কিছুটা গ্রামীণ পরিবেশে মানুষের কথাবার্তা শুনেই আমি বুঝতে পারি যে আমার অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলোর সাথে এটির পার্থক্য আসলে কোথায়। ইতিহাসের ঘটনাচক্রে যেহেতু এটা পশ্চিমে পৌঁছে গিয়েছে, এখানে বিচারটাও আপনাদের। এখানে আফ্রিকা আসলে কী সেই বিষয়টা দেখা বা বুঝে নেওয়ার দায়ও আপনাদের। আপনাদের অনুভূতি বা মন্তব্যগুলোই আমাকে আমার পরবর্তী কাজগুলো যাতে আরও ভাল হয়, তার পিছনে উৎসাহ জোগাবে।
যেহেতু ‘মূলাদে’-র মাধ্যমে অনেক সাড়া, প্রশংসা পাচ্ছি, আমার মধ্যে এক ধরণের ঘোর কাজ করছে। পরের চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবছি। যেহেতু এটা শহুরে আবহে তৈরি করার চিন্তা করছি, সে ব্যাপারে বিভিন্ন সমস্যাও মাথা জুড়ে আছে।
তবে আফ্রিকার শহরের কথা বলতে গেলে এটাও বলতে হয়- লন্ডন, আবিদজান অথবা পৃথিবীর অন্য যে কোন শহরেই হোক না কেন, বিল্ডিংগুলোর চেহারা আদতে একই। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সেই বিল্ডিংএ বসবাসকারী নারীপুরুষেরা- তারা আসলে কীরকম জীবনযাপন করছে? আসলে সবকিছুই বিস্তারিত আপনি জানবেন, এই আশা করা যায় না। এটার উপরেই আমি এই মুহূর্তে কাজ করছি।
ব.গ্রি. : আপনার পরিচালিত ট্রিলজির সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ব্রাদারহুড অব র‍্যাটস (Brotherhood of Rats) নিয়ে আমি বেশ উচ্ছ্বসিত। কারন এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় – শহুরে আবহের মধ্যে আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা ও তাদের সরকার তথা শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত জটিলতার যে আবর্ত, সেটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ও.সে. : এটা আসলে আমার কাজেরই অংশ। শহরকেন্দ্রিকতা ধরে রাখলে গ্রামীণ মানুষের কাছে এই ছবির অর্থপূর্ণতা পৌঁছে দিতে আমি ব্যর্থ হব। আমি চিন্তা করি এমন ছবি নির্মাণ করার, যাতে ক্যাসামান্স*-এর (Casamance) একজন কৃষকও বুঝতে পারে আসলে কী চলছে।
তাছাড়া আমি শহর এলাকায় চলমান যাবতীয় কপটতার বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলতে চাই। আমি নতুন প্রজন্মের মানুষের কথা বলছি। এই রুমে উপস্থিত মানুষেরাই শুধু নয়, যারা এই মুহুর্তে নিজেদের বাড়িতে অবস্থান করছেন, প্রত্যেককে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব, সেটা আমার চিন্তার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে।
ব.গ্রি. : ন্যুমেরিক (numerique), অর্থাৎ ডিজিটাল চলচ্চিত্র সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

ও.সে.: যা কিছু কলাকৌশল আমরা সার্থকভাবে ব্যবহার করতে পারি, সবই আমাদের জন্য ভালো। এখানে ‘লৈঙ্গিক সংগ্রাম’ (battle of the sexes), অর্থাৎ বৈবাহিক সূত্রে সম্পর্কিত নারী-পুরুষের মধ্যকার টানাপোড়ন জিনিসটাকেই মুখ্য হিসাবে দেখতে হবে।
ব.গ্রি.: এখন আমি কিছুটা আগের সময়ে চলে যাব। চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করার আগেই আপনার জীবনধারা বেশ সমীহ-জাগানিয়া ছিল। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনি লড়েছেন; মার্সেই (Marseilles) শহরে বন্দর-শ্রমিকের কাজও করেছেন। তবে সেখানে থাকাকালীন মেরুদন্ডে আঘাত পাওয়ার পরে আপনি তুলনামূলক অল্পশ্রমের কাজ খোঁজা শুরু করেন। আপনি আফ্রিকান সাহিত্য এবং এর প্রবাসী ব্যবহার নিয়ে পড়াশুনা করেন। বিশেষ করে হারলেম রেনেসাঁর* (Harlem Renaissance) গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, জ্যামাইকান ঔপন্যাসিক ক্লদ ম্যাকে (Claude McKay) এবং মার্সেই এর বন্দর এলাকা এবং সেখানকার সংস্কৃতিতে আফ্রিকান ছাপ নিয়ে তাঁর মতামত আপনাকে আকৃষ্ট করে।
ও.সে.: আসলে নিজের জীবন নিয়ে কথা বলা আমার জন্য কঠিন- আমার জীবন আমার নিজের কাছেই একরকম অজানা। যদিও আমি বলতে পারি যে প্রচুর ভ্রমণ করে আমার জীবনের একটা বড় অংশ কেটে গিয়েছে, এর মানে এই নয় যে আমি নিজেকে পরিষ্কারভাবে চিনে উঠতে পেরেছি।
ব.গ্রি.: বেশ। নারীদের সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
ও.সে.: আমি সকল নারীকেই ভালবাসি। এমন কোন পুরুষ মানুষের অস্তিত্ব থাকা কি আদৌ সম্ভব, যে কিনা নারীদের ভালবাসে না?
ব.গ্রি.: ইংল্যান্ডের একটা ঘটনা বলি। আপনি চাননি যে ‘সেডো’ (Ceddo) চলচ্চিত্রটি আমি দেখাই; তবে আমি খুব আগ্রহভরে দেখাতে চেয়েছিলাম। আমার আগ্রহের মূল কারণ ছিল চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য, যেখানে দেখানো হয় যে একজন স্বাস্থ্যবান নারী মাটির উপরে একটি রেখা টেনে দিচ্ছে। আফ্রিকার চলচ্চিত্র, বিশেষ করে আপনার চলচ্চিত্রে নারীদের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটি আপনার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ও.সে.: এখানে আমাদের অতীতের সভ্যতার দিকে তাকাতে হবে। আমি যখন বেড়ে উঠি, তখন আফ্রিকার বিবাহিত নারীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের কোমরে বেল্ট বাঁধতো। আমার মনে হয়, এটা তাদের সতীত্ব ও বিশ্বস্ততার একটা চিহ্নস্বরূপ। এর সাথে পুরুষদের কোন সংশ্রব নেই। যখন একজন নারী এই বেল্ট খুলে বাতাসে নাড়াতো, তখন বুঝাতো যে- তার জীবন ও সম্মান, দুইটাই চরম হুমকির মুখে। যখন তারা আমার মত স্বামীদের সামনে ওই বেল্ট খুলে বাতাসে নাড়বে, আমরা কেউই সেটা অগ্রাহ্য করতে পারবো না। এসব মুহুর্তেই সমাজ নারীদের ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারে। আপনি শারীরিকভাবে হয়তো অত্যাচার করতে পারেন, কিন্তু নিয়ম আপনি ভাঙতে পারবেন না।
তবে এগুলো সবই প্রাচীন আফ্রিকার কথা। বর্তমান সময়ে নারীরা অনেকেই স্বর্ণের বা চামড়ার বেল্ট পরে। তবে এর মানে এই নয় যে তারা সবাই বিশ্বস্ততা রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ব.গ্রি.: মাদাম কুলিবালি ( Fatoumata Coulibaly, যিনি Moolaadé চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র ‘Colle’-কে রূপায়িত করেছেন), এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করে আপনার অনুভূতি কী, দয়া করে জানাবেন?
কুলিবালি.ফা.: শুরুতেই ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আফ্রিকার চলচ্চিত্রের ব্যাপারে আপনার আগ্রহ রয়েছে, এটা পরিষ্কার। এই ছবিতে অভিনয়ের ডাক পাবার আগে আমি মালি (Mali)-র রেডিও ও টেলিভিশনে কর্মরত ছিলাম। নারী ও শিশু, অর্থাৎ পরিবারগুলো ছিল আমি যেখানে ছিলাম, সেই প্রোগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু। কাজের সুবাদে আমাকে গ্রামীণ এলাকায় অনেক ঘুরতে হয়েছে; সেখান থেকে যথাসম্ভব বেশি পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে হয়েছে।
আমি দেখেছি যে গ্রাম এলাকায় বন্ধ্যাত্বের উদ্দেশ্যে করা স্ত্রী-অঙ্গচ্ছেদের* (FGM) কারনে সৃষ্টি হওয়া অতিরক্তপাতে (haemorrhaging) অনেক তরুণী মৃত্যুবরণ করেছে। তবে যখন আমি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়েছি, তখন ব্যপক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
আমি নিজে এই বিষয়ের উপরে একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছিলাম, যেটা মাত্র একবার মালি-র টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। পরে সেখানকার কিছু মানুষ সেই টেপটা লুকিয়ে ফেলে আর বলে যে সেটা হারিয়ে গেছে। সেই সময়ে প্রশাসনও FGM সংক্রান্ত যে কোন তথ্য প্রকাশ হতে দিতে চায় নি। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম কাজ করে যাওয়ার। আমি নারীদের সহায়তাদানকারী একটা NGO-র সাহায্য নিয়েছিলাম। আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে নারীদেরকে ফরাসি বা ইংরেজিতে নয়, তাদের মাতৃভাষাতেই স্বাস্থ্যসচেতনতা ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে শেখানোর চেষ্টা করেছি। আমরা গ্রামের সর্দার থেকে শুরু করে ছেলেবুড়ো সবাইকেই উপস্থিত রাখার চেষ্টা করেছি। তবে সরাসরি FGM প্রসঙ্গ উঠানো হয় নি; দরকারি বিষয়ে আগে কথা বলেছি। কিছুক্ষন আন্দাজে হাতড়ানোর পরে বুঝেছি যে এখনো যৌনতা একরকম ট্যাবু হিসাবেই দেখা হয়। তাছাড়া সর্দাররাও অসন্তোষ নিয়ে বলে যে আমরা তাদেরকে তাদের প্রাচীন আচারপ্রথা থেকে বঞ্চিত করার অভিপ্রায় নিয়েই এসেছি। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে যে আমাদের জন্মের আগেই ওইসব প্রাচীন প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারা এই বলে আমাদের দোষারোপ করেছেন যে আমরা বাইরের অর্থবলে তাদের জীবনযাপনের রীতি নষ্ট করতে চেষ্টা করছি। তবে আমরাও আমাদের জায়গা থেকে হাল ছাড়ি নি।
মাঝেমধ্যে আমরা নারীশরীরের আদলে পুতুল ব্যবহার করেছি। যখন প্রসবকালীন যন্ত্রণা আমরা পুতুলের অঙ্গ নির্দেশ করে করে বিস্তারিত বুঝানোর চেষ্টা করেছি। অনেকে অবশ্য লজ্জা পেয়ে মুখ ঢেকে রাখে; তবে আমরা বিভিন্ন কৌতুক, গল্প ইত্যাদি মাধ্যমের সহায়তা নিয়েছি। এভাবে আমরা তাদের সামনে তাদের শারীরিক প্রতিরূপ দেখিয়ে আসল বৈজ্ঞানিক সত্য উন্মোচন করেছি। মালি-তে এই ধরনের কাজে আমি বেশ দক্ষ ও জনপ্রিয় ছিলাম। সেই অভিজ্ঞতাগুলো এই জায়গাতেও আমাকে সাহায্য করেছে। কিছু সময় পরে তারা চোখ আর বন্ধ না করে বাচ্চা জন্মদানের প্রক্রিয়া মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। অবশ্য ধাত্রীবিদ্যার উপস্থিতিও জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। মানুষ প্রশ্ন করছিল; কথোপকথন চলছিল। আমরা স্ত্রী-অঙ্গচ্ছেদের খারাপ ফলাফল নিয়ে কথা বলেছিলাম; মনে হয় আমরা অনেকটাই সফল।
মি. সেমবেন তখন বামাকো (Bamako)-তে চরিত্র বাছাই (casting) করছিলেন; অবশ্য তিনি তখন জানতেন না যে আমি এসব কাজে আগে থেকেই জড়িত। আমাকে তাঁর ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য বেছে নেওয়ায় আমি নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করি। আমি এও মনে করি, আমার যে সংগ্রাম, এটা মাত্র তার শুরু। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে- এই সংগ্রামে আমাদের পাশে থাকুন, আমাদের সাহায্য করুন। এভাবেই আমরা একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারবো।
ব.গ্রি.: এই পরিস্থিতে আমার চলচ্চিত্রের দুটো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ডায়ালগ মনে পড়ছে। একটি হচ্ছে ‘কোল’-এর স্বামীর “পুরুষ হতে গেলে কেবল দুটো অণ্ডকোষ থাকলেই হয় না; আরও অনেক বেশি কিছুর প্রয়োজন হয়।”তবে সবচাইতে শক্তিশালী ডায়ালগ আমার মতে “আফ্রিকা আসলেই একটা কুত্তী! ”
এই ডায়ালগ দুটো ব্যাখ্যা করবেন কি?
ও.সে.: “আফ্রিকা আসলেই একটা কুত্তী! “- কথাটি এসেছে মার্সেনারি, মানে ভাড়াটে সৈনিকদের কথা থেকে। এটা তাদের স্বচক্ষে দেখা মর্মান্তিক সব অভিজ্ঞতা মন্থনকারী বাক্য। কথাটি আমাকে আলোড়িত করেছে বলেই হয়ত অবচেতনভাবে তাদের মুখে আমি ডায়ালগটি বসানোর প্রয়াস পেয়েছি।
ব.গ্রি.: এটার কারনটা কি বলবেন?
ও.সে.: সরাসরি বলতে গেলে বলতে হয়, আফ্রিকাকে আমি ভালবাসি বলেই তাকে কুত্তী বলে সম্বোধন করেছি। এটা ভালবাসার জায়গা থেকে এসেছে; এখানে নেতিবাচক ভাবে নেওয়ার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। এক ধরনের আকুতি থেকেই এই কথাটি এসেছে।
আরেকটি ডায়ালগ, যেটার ব্যাপারে আপনি বললেন, সেটা আসলে আফ্রিকায় বিভিন্ন ভাষায় বহুল ব্যবহৃত প্রবচনের মত। বাম্বারা (Bambara) ভাষায় এই কথাটাই এভাবে বলা হয় “শুধু ট্রাউজার্স পরলেই পুরুষ হওয়া যায় না।”তবে কথাটাকে আরও শানিত করার জন্যেই আমি পরিবর্তন করেছি এভাবে, “পুরুষ হতে গেলে কেবল দুটো অণ্ডকোষ থাকলেই হয় না; আরও অনেক বেশি কিছুর প্রয়োজন হয়।”বাম্বারা ভাষায় এটা একটা অর্থপূর্ণ মেটাফর, কারন লিঙ্গত্বকচ্ছেদ বা খৎনার (circumcision) পূর্বে কোন পুরুষ সন্তান ট্রাউজার্স পরার অধিকার লাভ করে না। লিঙ্গত্বকচ্ছেদ দ্বারা পুরুষত্বে উত্তীর্ণ হওয়ার একটা প্রতীক বুঝানো হয়। এই মেটাফোর-টাই আমি কিছুটা পরিবর্তন করে ব্যবহার করেছি।
ব.গ্রি.: আপনি বলেছেন যে আফ্রিকার সমাজ অনেকটা মাতৃতান্ত্রিক; নারীদেরকে শক্তির উৎস হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে পশ্চিমে, আমাদের কাছে বহুগামিতা গ্রহণযোগ্য নয়; ভালভাবে দেখাও হয় না। তবে আপনি খুব সূক্ষ্মভাবে অন্যান্য প্রথার পাশাপাশি এটাও তুলে ধরেছেন। আপনার সিনেমার প্লট অনেকটা বহুগামিতাপূর্ণ অবস্থার প্রতিভূ; তবে নারীদেরকে আপনি মূল নিয়ন্ত্রক হিসাবে দেখিয়েছেন। এটাই কি চলচ্চিত্রে আফ্রিকার ভাষার প্রয়োগ, এটাই কি আফ্রিকার নান্দনিকতা?
ও.সে.: আমি যতদূর জানি, আফ্রিকাকে নারী হিসাবেই ধরে নেওয়া হয়। আমার স্বল্পজ্ঞানে মনে হয়েছে ২০০০ বছরের খ্রিস্টীয় দীক্ষা এখানে পরিপূর্ণ মানবিকতা আনতে পারে নি। আফ্রিকার নিজস্ব শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে এই নারীধর্মিতা, যেটার কথা আমি বললাম। আমার বা আমার পিতা, যার কথাই আপনি বলেন, নারীরাই আমাদের এই সম্মোহনের মধ্যে রেখেছে যে আমরা পুরুষরাই সবকিছুর নিয়ন্তা। আসলে আমাদের পুরুষত্ব পর্যন্ত নারীদের দৃষ্টি আর নিয়ন্ত্রণের উপরে নির্ভরশীল। নারীদের ছাড়া আসলেই আমাদের অস্তিত্ব নেই। এটাকে আমি ইতিবাচক ভাবেই দেখি।
ব.গ্রি.: শেষ পর্যায়ের প্রশ্ন, এটা একই সাথে রাজনীতি ও দর্শনের সাথে জড়িত, মূলত আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বা প্যান-আফ্রিকানিজম (pan-Africanism) প্রসঙ্গে। চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে আপনি আফ্রিকার চেতনা, আফ্রিকার চিন্তা, আফ্রিকার মানুষের জন্য লড়াই করছেন। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষ, এমনকি এই রুমের ভিতরে আমি নিজেও জাতিগতভাবে ‘soixante-huitard’* ভুক্ত। তাই আপনার সংগ্রামের মর্ম আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি। তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলোর কাছে কি প্যান-আফ্রিকানিজম কোন আবেদন সৃষ্টিতে সক্ষম হবে? আজকের দিনে কি এর কোন অর্থপূর্ণতা আসলেই আছে?
ও.সে.: আমার কাছে, যা কিছু ঐক্য সৃষ্টি করতে পারে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যা কিছু অর্থদ্যোতনা আর শান্তি বয়ে আনে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমার মতে, একটা পর্যায়ে প্যান-আফ্রিকানিজম একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে এই প্যান-আফ্রিকানিজমের কেন্দ্র ছিল লন্ডন। মূলত প্রথমবার আমি লন্ডনে যাই প্যান-আফ্রিকানিজম বিষয়ক এক সভায় যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ১৯২০ এর দিকে আফ্রিকা কিন্তু প্যান-আফ্রিকানিজমের কেন্দ্র ছিল না; প্রবাস এলাকাতেই কেন্দ্রগুলো গড়ে ওঠে। সেই সময়েই আমরা প্রথমদিকের শিক্ষিত আফ্রিকানদের সংস্পর্শে আসি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে এটা আরও দৃঢ় হয়; পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষ পরস্পরকে তখন চিনতো। চীনের চৌ এন -লাই (Chou En-Lai), জর্জ প্যাডমোর (George Padmore), ডাব্লিউ ই বি দ্যুবয় (WEB DuBois) প্রমুখেরা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পরেও আমরা প্যান-আফ্রিকানিজমের আদর্শ লালন করে গিয়েছি, যাতে আমাদের মহাদেশীয় ঐক্য অটুট থাকে। আমার কাছে এটা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।
ব.গ্রি. : কিন্তু এখনকার সময়ে?
ও.সে.: বর্তমানে আমাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কূটনৈতিক কর্মপন্থা, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আফ্রিকার ফরাসিভাষী অংশে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মত বিচ্ছিন্নাবস্থায় আর কেউ নেই। আমার মনে হয়, আফ্রিকার মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিতে বর্তমানে ফ্রান্সই নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। আমাদের অধিকাংশ রাষ্ট্রপতিরই দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে; একটা আফ্রিকার, অন্যটা ফ্রান্সের। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে তাঁরা প্যারিসে রওনা দেন; সিদ্ধান্তগুলো সব সেখানেই নেওয়া হয়। এরকম পরিস্থিতিতে প্যান-আফ্রিকানিজমের প্রসঙ্গ উঠানো কার্যত অসম্ভব। কিছুটা বাগাড়ম্বরের মত শোনাবে, কিন্তু আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর ভিতরে রাজনৈতিক সীমারেখা টেনে দেওয়ার কি আসলেই কোন প্রয়োজন ছিল? এই কাল্পনিক সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া কাঁটাতারের বেড়া তাঁরা ভেঙে দিচ্ছেন না কেন? আফ্রিকায় শিক্ষার প্রসারের ব্যাপারে তাঁদের এত গড়িমসি কেন?
এছাড়াও অতীতে ফ্রান্সের উপনিবেশে যে রাষ্ট্রগুলো ছিল, তাদের বার্ষিক বাজেট সুনিশ্চিত করতে এখনো ফ্রান্সের তাঁবেদারি করে যেতে হয়। এ কারনেই আমার কাছে বিষয়টা জটিল মনে হয়। তবে আমি আশাবাদী, একদিন আমরা সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা লাভ করবো।
আমাদের সবচাইতে বড় লড়াইটা চলছে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে। অনেক ইউরোপীয় এই লড়াইতে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন; তাঁদের অনেকে আবার প্রতিপক্ষের বুলেটের লক্ষ্যবস্তুতেও পরিণত হয়েছেন। এখন যেহেতু এই সংগ্রাম একটা বিস্তৃত অর্থনৈতিক সংগ্রামে রূপ নিয়েছে, তাই সবার আগে আমাদের আবশ্যক হচ্ছে নিজেদের মর্যাদা ধরে রাখা। ইউরোপ বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে। তাই আফ্রিকা আর ইউরোপের ভিতরে সুস্পষ্ট বিভাজন থাকা ভালো। এখানে, অর্থাৎ পশ্চিমে প্রচলিত আইনগুলোও সংশোধন বা সংস্কার করা দরকার।
লক্ষ্য করলে জানবেন, টী-শার্টের বাজারের কারনে চীনের সাথে ইউরোপীয় দেশগুলোর বিবাদ রয়েছে। কারন তাদের বাজারগুলো চীনা ট-শার্টে ভরে গিয়েছে। গত শতাব্দীতে এই ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডই সাংহাইতে বোমাবর্ষন করেছিল; সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু তারা এখন আর সেটা করতে পারবে না। কারন চীন, ভিয়েতনাম এসব দেশও নিজেদের সংঘটিত করে চলেছে। আফ্রিকায় আমাদের ভিতরে এই জিনিসটারই অভাব অনুভব করি। এতকাল অন্যদের আয়ত্তাধীন থাকার কারনে আমরা কেবল সাহায্য প্রার্থনা ছাড়া অন্য কিছু করাই ভুলে গেছি। আমরা কথা বললে অনেকে এটাকে হাসির খোরাক হিসাবেও নেয়।
এরপরে আসে তুলা চাষের প্রসঙ্গ। সবাই জানে যে দাসপ্রথা যখন চালু ছিল, তখন কৃষ্ণাঙ্গদেরকে তুলা চাষে লাগানো হত। এখন তারা আর আমাদের তুলা চাষ করতে জবরদস্তি করে না; আমরা নিজেরাই চাষ করি। সেটা তাদের আর প্রয়োজন হয় না। তুলা থেকে বস্ত্রশিল্প গড়ে তোলার জন্য একটা ফ্যাক্টরি পর্যন্ত আমাদের নেতারা এখনো করতে পারেন নি। এখানে যা কিছু ব্যবহার করা হয়, সেগুলোই এখানে তৈরি করা সম্ভব; আরও বেশি গুনগত মান বজায় রেখেই সম্ভব। আমরা বসে থাকি, কবে ইউরোপ থেকে জিনিসপত্র আসবে। তারা আমাদের যেসব জিনিস বিক্রি করছে, সেগুলো আবর্জনা। আফ্রিকার যে কোন বড় শহরে গেলেও আপনার মনে হবে যে আপনি স্যালভেশন আর্মি স্টোরে আছেন। তারা যে এন.জি.ও. বানিয়েছে; তাদের কাজ আসলে কী, জানেন? আমাদের কাছে পুরানা জামা-কাপড় বিক্রি করা! তরুণ প্রজন্মের এই সব কাহিনী জানানো আমাদের দায়িত্ব। তাহলেই এই সংগ্রামের মশাল ভবিষ্যতে সমুজ্জ্বল থাকবে।
ব.গ্রি. : আপনার কথার সূত্র ধরেই আমার পরের প্রশ্ন। ‘Make Poverty History, Live 8, Hear Africa 05’ শিরোনামে ব্রিটেন যে বড়সড় ক্যাম্পেইন শুরু করেছে জনগনের সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে; হয়ত এতে আর্থিক অনুদানও থাকবে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ও.সে. : আমার মনে হয় এগুলো প্রতারণা ছাড়া কিছুই না। আফ্রিকার যেসব রাষ্ট্রপ্রধান এতে সায় দেবেন, আমার চোখে তারা মিথ্যাবাদী। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সামনে একমাত্র রাস্তা হচ্ছে পরিশ্রম করা। দারিদ্র্য মানে হচ্ছে দুনিয়া জুড়ে ভিক্ষাবৃত্তি চালানো। যতদূর জানি, আপনাদের প্রধানমন্ত্রী এই ক্যাম্পেইনের নেতৃস্থানীয় জায়গায় রয়েছেন। কয়েক বছর আগে সিয়েরা লিওন (Sierra Leone)-এ ব্রিটিশ সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। এটা কি দারিদ্র‍্যের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য? এটা একাধারে ভুল আর মিথ্যার সংমিশ্রণ। এসব সত্য জানার দায় আফ্রিকানদেরই। আমার মনে হয় বিপ্লব শুরু করতে হবে নিজেদের আঙিনা, অর্থাৎ আফ্রিকা থেকেই।
ব.গ্রি. : বেশ, দেখা যাক এসব খবর আগামীদিনে সংবাদপত্রে আসে কি না। মনে হয় না, না আসার পক্ষে আপনি বাজি ধরবেন।
আমার সর্বশেষ প্রশ্ন। ফরাসি টেলিভিশনের ‘রিডীউ রোগ’ (Rideau Rouge) নামে এক প্রোগ্রামে আপনি অংশ নিয়েছিলেন। ‘বারকিনা ফাসো’ (Burkina Faso)-র জনৈক তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালকের (realisateur) সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে আপনি বলেছিলেন, “আফ্রিকার চিত্র পরিচালকদের এত নম্রতা মানায় না।”এর পরেই অবশ্য আপনি আফ্রিকান চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে চলে যান। এই দুটো বিষয় ব্যাখ্যা করবেন কি?
ও.সে. : আমি বিশ্বাস করি, সমগ্র আফ্রিকা জুড়ে চলচ্চিত্রের বিকাশ অত্যাবশ্যক; কারন নিজেদের ইতিহাস সম্বন্ধীয় জ্ঞানেই আমরা পিছনে পড়ে আছি। আমাদের এমন একটা সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে হবে, যেটা একান্তই আমাদের নিজস্ব। সেই মুহুর্তের যে ছবিগুলো আমার চোখে ভেসে আসে, সেগুলো অত্যন্ত আনন্দময়, অর্থপূর্ণ। এই সময়ে চলচ্চিত্র শুধুমাত্র পরিচালকদের হাতেই রয়েছে; কারণ শাসকগোষ্ঠী চলচ্চিত্র জিনিসটাকে ভীতিকর বলেই মনে করে। প্রসঙ্গত, ইউরোপীয়রা যথেষ্ট স্মার্ট ; প্রতি রাতে তারা আমাদের মননের উপরেও সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার করে চলে। তারা তাদের সমাজব্যবস্থা, জীবনবিধি নিরন্তরভাবে আমাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের অনেক মানুষ বর্তমানে ব্রিটিশ ধাঁচের স্যুট, টাই পরেন। আমাদের ‘ফার্স্ট লেডি’-দেরকে বলা হয় ‘ডিউটি-ফ্রি লেডিজ’। ব্যপক হারে ইউরোপীয় পারফিউম আর চলতি ফ্যাশনের পোষাক ছাড়া তাদের চলে না।

অজানা শব্দ :
* ‘soixante-huitard ‘ বলতে বোঝায় ১৯৬৮ সালের মে মাসে ফ্রান্সে সংঘটিত নাগরিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অথবা সমর্থকগোষ্ঠী। এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা।
* ‘Female genital mutilation (FGM)’ বলতে বোঝায় চিকিৎসা-সংক্রান্ত কোন কারণ ব্যতীত নারী প্রজনন অঙ্গের কর্তন বা ছেদন, যা তীব্র যন্ত্রণাকর । আফ্রিকা ও এশিয়ার কোন কোন এলাকায় এটা একটা প্রথা হিসাবে প্রচলিত রয়েছে।
* ‘Harlem Renaissance’ ছিল ১৯২০ সালের দিকে নিউ ইয়র্কের হারলেম এলাকায় সংঘটিত এক সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নান্দনিক বিপ্লব। তখন এটা ‘New Negro Movement’ নামে পরিচিত ছিল; এই নামকরণ করেন এলেন লোক (Alain Locke), ১৯২৫ সালে প্রকাশিত সংকলনে। ‘Harlem Renaissance’-কে আফ্রো-আমেরিকান শিল্পের পুনর্জন্ম হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
* ‘Bambara’ গোত্রের জাতীয় ভাষা ‘Bamanankan’ মালির রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালু রয়েছে। জন্মসূত্রে ৫ মিলিয়ন ও দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ১০ মিলিয়ন, মোট ১৫ মিলিয়ন মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করে।
* ‘Mandinka’ হচ্ছে আফ্রিকার একটা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, যাদের পৃথিবীব্যাপী জনসংখ্যা প্রায় ১১ মিলিয়ন। তারা মালির রাজবংশের বংশধর। ১৩শ শতাব্দীতে Malinké/Maninka গোষ্ঠীর রাজা ‘সুনদিয়াতা কেইতা’ (Sundiata Keita)-র নেতৃত্বে তারা ক্ষমতা পায়।
* ‘Fula’ অথবা ‘Fulani’ অথবা ‘Fulɓe’ পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল (Sahel) অঞ্চলের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী। এদের মোট জনসংখ্যা ২০ থেকে ২৫ মিলিয়ন।
* গাম্বিয়ার (Gambia) দক্ষিণে ‘Casamance’ নদী পরিবেষ্টিত সেনেগালের (Senegal) একটা অঞ্চলের নাম ‘Casamance’, যেটা ‘Lower Casamance’ ও ‘Upper Casamance’ দুই অংশে বিভক্ত। ‘Casamance’ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ শহরের নাম ‘জিগুইনচর’ (Ziguinchor)।  ২০০৫

Related posts